বরিশাল
বরিশালে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে প্রত্যাহার হওয়া ব্যক্তিই মাউশির নতুন ডিজি
নিজস্ব প্রতিবেদক : স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর পর আওয়ামী লীগের ভোল্ট পাল্টিয়ে এন্ট্রি আওয়ামী লীগ সাজার চেষ্টা করা, শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের মুখে অধ্যক্ষ পদ থেকে প্রত্যাহার হওয়া ও বরিশাল সিটির সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর ঘনিষ্ঠ অনুচর হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক ড. এহতেসাম উল হককে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) নতুন মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্বে) হিসেবে পদায়ন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
রবিবার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে তাকে এই পদে পদায়ন করা হয়। এর আগে তিনি পটুয়াখালী সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগে কর্মরত ছিলেন। তিনি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ১৪ ব্যাচের কর্মকর্তা এবং রসায়ন বিষয়ের অধ্যাপক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২১ সালের জুন মাসে বরিশাল সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ অধ্যাপক ড. এহতেসাম উল হককে বরিশাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ পদে পদায়ন করান।
পুরো বরিশাল নগরীতে বরিশাল সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর ঘনিষ্ঠ অনুচর হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। বরিশাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ পদে থাকাকালীন আওয়ামী বলয়ের প্রভাবশালী অধ্যক্ষ হওয়ায় ক্ষমতার দাপটে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ লোপাট, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে দুর্ব্যবহারসহ বিস্তর অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে।
পাঁচ আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর তিনি আওয়ামী লীগের ভোল্ট পাল্টিয়ে আওয়ামী বিরোধী হিসেবে পরিচিত পেতে তৎপরতা শুরু করেন। হাসিনা পালানোর পর নভেম্বর মাসে অধ্যক্ষ এহতেসাম উল হকের পদত্যাগের দাবিতে টানা আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থী। সড়ক অবরোধ, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন সহ নানা কর্মসূচী পালন করেন তারা।
সে সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, বরিশালের সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মো. এহতেসাম উল হক ২০২১ সালের জুন মাস থেকে এখন পর্যন্ত কর্মরত আছেন।
বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর অনুচর ছিলেন। যোগদানের পর থেকে সাবেক মেয়রের সাথে সম্পর্কের কারণে বিভিন্ন সময়ে ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করেছেন।
তিনি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সম্পদ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন। এমনকি কোন অভিভাবক অধ্যক্ষের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি সহজে দেখা করেন না। কোন কাজে সহযোগিতা করেন না, কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে দুর্ব্যবহার করেন।
গত ০৫ আগস্ট সরকার পতনের পর তিনি সুর পাল্টে আওয়ামী লীগ বিরোধী সাজার অপচেষ্টা করছেন। শিক্ষার্থীরা তাদের ১০ দফা দাবি তুলে ধরে শীঘ্রই ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর, দুর্নীতিবাজ ও নৈতিকতাহীন অধ্যক্ষকে অপসারণ করার দাবি জানান।
তা না হলে কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার হুশিয়ারি দেন শিক্ষার্থীরা। তার এসব অনিয়মের প্রতিবাদ করায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের চাকরি থেকে বরখাস্তসহ এসিআর খারাপ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ করেন শিক্ষক-কর্মচারীরা।
পরবর্তীতে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা অধ্যক্ষের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে মহানগর পুলিশ কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে শিক্ষা সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন এবং সাত দিনের আল্টিমেটাম দেন। আল্টিমেটাম শেষ হওয়ার আগেই গত ১৪ নভেম্বর অধ্যাপক ড. এহতেসাম উল হককে পটুয়াখালী সরকারি কলেজে রসায়ন বিভাগে বদলি করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরিশাল স্কুল এন্ড কলেজের এক শিক্ষক বলেন, ‘ড. এহতেসাম উল হক স্যার বরিশাল সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর ঘনিষ্ঠ অনুচর হিসেবে পরিচিত ছিল যা বরিশালের সবাই জানেন।
মেয়রের একাধিক প্রোগ্রামেও তিনি উপস্থিত থেকেছেন। তবে পাঁচ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর তিনি নিজেকে আওয়ামী বিরোধী সাজার তৎপরতায় ব্যস্ত ছিলেন। অবশেষে তিনি সফল। তা না হলে মাউশির ডিজির মত পদে তিনি পদায়ন পেলেন কীভাবে। ‘
এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিতর্কিত ভূমিকা, আওয়ামী লীগের মন্ত্রীর আশীর্বাদপুষ্ট এবং শিক্ষার্থীর আন্দোলনের মুখে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ খোন্দকার কামাল হাসানকে অধ্যক্ষ পদ থেকে প্রত্যাহার করে মাউশিতে ওএসডি করা হয়। পরবর্তীতে তাঁকে যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে পদায়ন করা হলে বিতর্কের মুখে দশ কর্মদিবসের মাথায় তাকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে মাউশিতে ওএসডি করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘শিক্ষা ক্যাডারের একাধিক কর্মকর্তাকে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে পদায়ন পেলেও তাকে বদলি করা হয়েছে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের আমলে পদায়ন পাওয়ায়।
অথচ মাউশির ডিজির মত পদে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সহচর এবং পাঁচ আগস্টের পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে অধ্যক্ষ পদ থেকে প্রত্যাহার হওয়া ব্যক্তি কীভাবে পদায়ন পান তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা শিক্ষা ক্যাডারদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করছে। বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করি।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ১৪ ব্যাচের দুই জন অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পদায়ন বা বদলির ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামক হিসেবে মন্ত্রণালয় দেখেছে তার সাথে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি’না।
এমন অনেক কর্মকর্তা আছে যারা আওয়ামী লীগের সাথে কোন সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও আওয়ামী আমলে পদায়ন পাওয়ায় তাদেরকে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী উল্লেখ করে বদলি করা হয়েছে।
অথচ ১৬ বছরের বঞ্চিত একাধিক উপযুক্ত কর্মকর্তা থাকা স্বত্ত্বেও কীভাবে মাউশির ডিজি পদে আওয়ামী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে প্রত্যাহার হওয়া ব্যক্তি পদায়ন পান তা বোধগম্য নয়। বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি জানাই।’
শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের মুখে অধ্যক্ষ পদ থেকে প্রত্যাহার হওয়া ও বরিশাল সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর ঘনিষ্ঠ অনুচর হিসেবে ব্যাপক পরিচিত থাকার পরেও কীভাবে মাউশির ডিজি পদে পদায়ন পেলেন জানতে চাইলেন অধ্যাপক ড. এহতেসাম উল হকের মুঠোফোনে কল করলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্য জোটের চেয়ারম্যান ও বিএনপির সাংগঠিনক সম্পাদক অধ্যক্ষ সেলিম ভুঁইয়া শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, ‘শিক্ষা অধিদপ্তরে চলতি দায়িত্বে যাকে ডিজি পদে পদায়ন করা হয়েছে তিনি আওয়ামী লীগের দোসর, শেখ হাসিনার প্রেতাত্মা এবং তার বিরুদ্ধে বরিশালে ছাত্র-জনতা এবং সুশীল সমাজ ফুঁসে উঠেছিল।
তিনি বরিশালের আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ ছেলে সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর ঘনিষ্ঠ অনুচর ছিলেন। এই মেয়রের ছত্রছায়ায় কলেজটিতে তিনি রামরাজত্ব কায়েম করেছিলেন।
শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের মুখে তাকে অধ্যক্ষ পদ থেকে অপসারণ করা হলেও এই আওয়ামী দোসরকে যে বা যারা মাউশির ডিজির দায়িত্ব দিয়েছে তাদেরকে আমরা অপসারণের দাবি জানাই।
শেখ হাসিনার এই প্রেতাত্বাকে ছাত্র-জনতা, শিক্ষক-কর্মচারী এবং সুশীল সমাজ কখনই মেনে নিবে না। তাকে প্রত্যাহার করা না হলে মাউশি ঘেরাও সহ কর্মসূচী দেবে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা।
আমি আগেও বলেছি এখনও বলছি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওয়ামী লীগের দোসরা রয়ে গেছে সেটা মাউশির ডিজি পদে শেখ হাসিনার প্রেতাত্মাকে পদায়ন করে আবারও প্রমাণিত হলো। অবিলম্বে এই ডিজিকে প্রত্যাহার করতে হবে।’ জানতে চাইলে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করেও তা পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, ড. ইহতেসাম উল হক ডিজিএ বি এম রেজাউল করীমের স্থলাভিষিক্ত হলেন। গত ৪ জানুয়ারি চাকরি শেষ করে অবসরে যান মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর রেজাউল করিম।
এর আগে গত বছরের ৫ আগস্টে সরকার পতনের পর ২১ আগস্ট মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের ভাগিনা অধ্যাপক নেহাল আহমেদ। তিনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ সচিবের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন।