স্বাস্থ্য
দেশে দুই যুগ ধরে থাকা এইচএমপিভি কতটা উদ্বেগের
বিশ্বজুড়ে এখন নতুন আলোচিত ভাইরাসের নাম হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস, সংক্ষেপে যা এইচএমপিভি নামেও পরিচিতি। তবে গবেষকরা বলছেন, এই ভাইরাস নতুন কিছু নয়। ২০০১ সালে দেশে প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত হয়। সেই সময় ঢাকার কমলাপুরের একটি বস্তিতে শিশুদের নমুনা পরীক্ষা করে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায় বলে বাংলা ট্রিবিউনকে নিশ্চিত করছেন গবেষক দলের সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিংস বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল ডিজিস এপিডেমিওলজি অ্যান্ড কন্ট্রোল বিভাগের সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট আবদুল্লাহ ব্রুকস। তার মতে, এই ভাইরাসের সংক্রমণের হার বছরের পর বছর পরিবর্তিত হতে পারে। বর্তমানে চীনসহ উপমহাদেশে এইচএমপিভির স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আক্রান্তের ঘটনা দেখা যাচ্ছে। দুই বছর আগেও যুক্তরাষ্ট্রে একই ধরনের উচ্চ আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছিল।
ইমেইলে যোগাযোগ করা হয় বিজ্ঞানী আবদুল্লাহ ব্রুকসের সঙ্গে। তিনি এইচএমপিভি নিয়ে বাংলাদেশে গবেষণার বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করেন। ২০০৭ সালে তাদের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে। আবদুল্লাহ ব্রুকস-সহ গবেষণার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন তখন ঢাকার আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রে (আইসিডিডিআর,বি) কর্মরত ছিলেন।
গবেষণার শুরুতেই গবেষকরা উল্লেখ করেন, ‘আমরা ২০০১ সালে বাংলাদেশের ঢাকার একটি বস্তিতে জ্বরজনিত এবং শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতায় আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) সঞ্চালনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছি। এইচএমপিভি হলো জ্বরে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে শনাক্ত করা সবচেয়ে সাধারণ একক ভাইরাস। এই জনসংখ্যার অসুস্থতার জন্য ভাইরাসটি উচ্চহারে অবদান রাখে বলে মনে হচ্ছে।’
গবেষকরা জানান, ১৯৯৮ সাল থেকে ঢাকার কমলাপুরের একটি বস্তিতে শিশুদের জ্বরের ওপরে গবেষণা চালিয়েছেন তারা। ২০০০ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে ২০০১ সালের ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮৮৯ ব্যক্তি জ্বর নিয়ে আমাদের ক্লিনিকে আসেন। তাদের মধ্যে ৮৮৮ জনের কাছ থেকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এই নমুনাগুলোর মধ্যে ১৩ বছরের নিচে ১২৮টি শিশু—যাদের জ্বর, চারদিন ধরে কাশি এবং ডেঙ্গু অ্যান্টিবডি নেগেটিভ ছিল, তাদের সিরাম নমুনা সংগ্রহ করেন গবেষকরা। সেখানে ইনফ্লুয়েঞ্জা ‘এ’ এবং ‘বি’ ভাইরাস পরীক্ষা করা হয়। এসব নমুনার মধ্যে ১০৭ জোড়া নমুনার সিরাম থেকে অন্যান্য ভাইরাসের পরীক্ষা করা হয়। তার মধ্যে ৬০টি নমুনায় বিভিন্ন ভাইরাস পাওয়া যায়, যার মধ্যে এইচএমপিভি ছিল ২০টি।
গবেষকদের মতে, শিশুদের শ্বাসতন্ত্রের রোগের ক্ষেত্রে ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে খুব একটা উৎসাহ না থাকায় এইচএমপিভি শনাক্তের বাইরে ছিল। এছাড়া সেই সময় এটি অনেকের কাছেই অজানা ছিল এবং এমনভাবে পরীক্ষা করারও সুযোগ ছিল না। এইচএমপিভি সম্ভবত এই জনসংখ্যায় নিউমোনিয়া এবং ব্রঙ্কিওলাইটিসের একটি প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেমনটি অন্যদের মধ্যে রয়েছে। ছোট শিশুদের মধ্যে তীব্র নিউমোনিয়ার কারণ হতে পারে এই ভাইরাস।
আবদুল্লাহ ব্রুকস জানান, আমাদের গবেষণার সময় ঢাকায় শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাল ইনফেকশন তীব্র ছিল। আমাদের গবেষণার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাসজনিত রোগ প্রতিরোধে একটি ভ্যাকসিন ট্রায়াল করা। আমরা বিশ্বাস করতাম যে তা সম্ভব ছিল। কিন্তু গবেষণার পর দেখলাম— আমাদের যে ধারণা ছিল ‘বাংলাদেশে উচ্চমাত্রার শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাল সংক্রমণ নেই’, সেটি ভুল ছিল। তখন এইচএমপিভি নিয়ে প্রচার করা অতটা প্রসিদ্ধ ছিল না।
তখনকার গবেষণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার দেখেছি, যেসব ভাইরাস শিশুদের মধ্যে সক্রিয় ছিল তার ১৫ শতাংশই ছিল এইচএমপিভি। শ্বাস-প্রশ্বাসের সিনসিটিয়াল ভাইরাস (আরএসভি) থেকেও বেশি ছিল ৫ বছরের নিচের শিশুদের মধ্যে।’
আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা ২০১৯ সালে আবারও একটি গবেষণা প্রকাশ করি। তখন দেখেছি যে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ এমনকি পাঁচ বছরের নিচে শিশুর নিউমোনিয়ার জন্য এইচএমপিভি দায়ী।’
এই বিজ্ঞানী আরও জানান, বছরের পর বছর ধরে দীর্ঘস্থায়ী তথ্য জোগাড় না করে, স্বল্পমেয়াদে যেকোনও বৃদ্ধিকে ‘প্রাদুর্ভাব’ হিসেবে দেখা সহজ— যা একাধিক বছর ধরে কেবল স্বাভাবিক পরিবর্তনের মধ্যে থাকতে পারে। কোভিড-১৯ বিশ্বের কাছে নতুন হলেও এইচএমপিভি নতুন নয়। ১৯৫০ সাল থেকে এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যেহেতু এর কোনও ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি, তাই এর সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী বাড়তে পারে। বেশিরভাগ শিশুদের শৈশবে এই সংক্রমণ হয়ে থাকে। যাদের কোনও কারণে হয়নি, তারা এখন ঝুঁকিতে আছে। এখানে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এই ভাইরাসের দুটি সেরোটাইপ আছে এবং অন্যান্য উপধরন আছে—যা সংক্রমণ বাড়াতে পারে তাদের মধ্যে, যারা এই ধরনগুলো দ্বারা সংক্রমিত হয়নি।
তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে বলা যায়, কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় এই সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে পারে।’ তবে আমার মতে, মানুষের মধ্যে নিয়মিত সঞ্চালনের ইতিহাসসহ এইচএমপিভি দীর্ঘস্থায়ী ভাইরাস হওয়ায় বিশ্বব্যাপী এটির মহামারির সম্ভাবনা কম। বিচ্ছিন্ন প্রাদুর্ভাব, এটা ঠিক আছে। তবে বৈশ্বিক মহামারির সম্ভাবনা কম।’
এদিকে করোনাভাইরাসের মতোই এই ভাইরাস চীন থেকে শুরু করে হংকং, মালয়েশিয়ায় ছড়িয়েছে। পাশের দেশ ভারতেও এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। তা নিয়ে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ।
চিকিৎসকরা বলছেন, এইচএমপিভি করোনাভাইরাসের মতোই শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায়। এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির ঠান্ডা, সর্দি-কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট, র্যাশ ওঠার মতো লক্ষণ দেখা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি বলছে, এইচএমপিভি সম্ভবত সংক্রামিত ব্যক্তি থেকে অন্যের মধ্যে হাঁচিকাশির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া স্পর্শের মাধ্যমেও সংক্রমণ হতে পারে। এটি মূলত শ্বাসতন্ত্রের ওপরের অংশে আক্রমণ করে। এটি কখনও কখনও নিউমোনিয়া, হাঁপানির মতো শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের আকার ধারণ করতে পারে। এই ভাইরাসের সুপ্তিকাল তিন থেকে ছয় দিন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘অহেতুক আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এই ভাইরাস আগেও ছিল। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। তবে যারা বৃদ্ধ, যারা অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্ত, তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি অন্যরকম। যেহেতু তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের জন্য আরও বেশি সাবধানতা জরুরি। একই সাবধানতা শিশুদের ক্ষেত্রেও জরুরি।’