বরিশাল
ঢাকা-বরিশাল সড়ক: পুলিশ-মালিক সিন্ডিকেটে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার
নিজস্ব প্রতিবেদক : পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ঢাকা-বরিশাল রুটের নতুন যাত্রা শুরু হয়। এরপরই এ রুটে বাসের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় পরিবহন মালিকরা।
কিন্তু বেঁকে বসেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র ফজলে নূর তাপস। তার নির্দেশে ওই রুটে বাস চলার অনুমতি বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় তাপসকে অনুরোধ করলেও পাত্তা দেননি তিনি। তবে ওই সময়ে আওয়ামী লীগ নেতা এনায়েত উল্লাহর ৬০টি বাসকে চলাচলের অনুমোদন দেওয়া হয়।
হানিফ ফ্লাইওভারে যানজটের অজুহাতে করপোরেশন সভা ও সমন্বয় সভায় এ রুটে বাস চলাচলের রুট পারমিট বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন তৎকালীন মেয়র তাপস। এ নিয়ে সিটি করপোরেশন থেকে বিআরটিএ চেয়ারম্যানকে চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা-বরিশাল রুটে বাস রুট পারমিট বন্ধ করে দেয় বিআরটিএ।
যানজটের অজুহাতে এ সড়কে রুট পারমিট বন্ধ থাকলেও থেমে নেই অবৈধ বাস। যাত্রীদের বাড়তি চাপ থাকায় রুট পারমিট না নিয়েই চলছে কয়েক হাজার বাস। কিছু অসাধু পুলিশ সদস্য ও বাস মালিক সিন্ডিকেট করে ওই সড়কে অবৈধ বাস পরিচালনা করছেন।
আন্তঃজেলা বাসগুলো যত্রতত্র চলাচল করছে। এতে অসংখ্য ঘটছে দুর্ঘটনা। অন্যদিকে রুট পারমিট বন্ধ থাকায় সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। এজন্য অবশ্য পুলিশকে নিয়মিত মাসহারা দিতে হচ্ছে বাসমালিকদের।
বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ঢাকা-বরিশাল রুটে মোট ১ হাজার ৪০৭টি বাস চলাচল অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর আরও প্রায় দুই হাজার বাসের চলাচলের অনুমতি চেয়ে আবেদন করে। কিন্তু তৎকালীন মেয়রের আপত্তির কারণে এনায়েত উল্লাহর বাস ছাড়া অন্য কোনো বাসের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, একটি বাসকে তিন বছরের জন্য রুট পারমিট দেওয়া হয়। প্রতি বাসের রুট পারমিট সরকার ভ্যাটসহ প্রায় ৭ হাজার টাকা রাজস্ব পায়। দুই হাজার বাসের রুট পারমিট দেওয়া হলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পেত সরকার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বিআরটিএকে চিঠি দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। চিঠিতে বলা হয়, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার ব্যবহার না করে আন্তঃজেলা গাড়ির ক্ষেত্রে অস্থায়ীভাবে রুট পারমিট না দেওয়ার অনুরোধ করা হয়।
এরপর থেকে বন্ধ রয়েছে এ রুটের পারমিট। এরপর ২০ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ সিটিকে চিঠি দেয় বিআরটিএ। সেখানে বলা হয়, ‘ঢাকা সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় চলাচল করে।
বিশেষ করে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ওই রুটে যাত্রীবাহী চলাচলকারী বাসের সংখ্যা অনেকাংশে বেড়ে যায়। তাই এ রুটে পারমিটের জন্য ৫০০টি আবেদন দপ্তরে জমা রয়েছে।’
এমতাবস্থায় দক্ষিণাঞ্চলের এ আন্তঃজেলা রুটে ২১ জেলায় চলাচলকারী যাত্রীবাহী বাসের ক্ষেত্রে দক্ষিণ সিটির পাঠানো চিঠির বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনার অনুরোধ জানায় বিআরটিএ। এই চিঠির পর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোনো উত্তর দেয়নি।
এরপর ১০ অক্টোবর বিআরটিএ এর চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় বলে, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর এ রুটে বাস চলাচলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন করে চলাচল করলেও অনেক বাসের পারমিট নেই।
বাস্তবতার আলোকে এসব বাস বন্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। বাস রুট রেশনালাইজেশন সভায় বিষয়টি আলোচনা করে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে চলাচল করবে না শর্তে রুট পারমিট প্রদান করা হবে মর্মে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে জানানো যেতে পারে। ওই নির্দেশনার আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করে মন্ত্রণালয়।
ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২ নভেম্বর ও গত বছর ২৩ মার্চ দক্ষিণ সিটিকে চিঠি দেয় বিআরটিএ। চিঠিতে জরুরি ভিত্তিতে মতামতের জন্য বলা হয়। তবে ওই দুই চিঠির আর উত্তর দেয়নি তখনকার দক্ষিণ সিটির মেয়র তাপস। বর্তমানে ওই রুটে দুই হাজারের বেশি রুট পারমিটের আবেদন জমা আছে বলে জানা গেছে।
বিআরটিএর একটি সূত্র বলছে, তাপসের নির্দেশে ঢাকা-বরিশাল রুটের পারমিট দেওয়া বন্ধ থাকলেও ৬০টি বাসের রুট পারমিট নিয়েছেন এনা পরিবহনের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ।
তখনকার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর নির্দেশে এসব বাসের পারমিট নেন তিনি। এসব বাসের রুট পারমিট দেওয়ায় বিলম্ব হওয়ার কারণে এনায়েত উল্লাহ বিআরটিএ কর্মকর্তাদের হুমকিও দিয়েছিলেন।
গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের আগেই দেশত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ নেতা ব্যারিস্টার তাপস। এ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে তার ব্যবহৃত ফোন নম্বরে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এনায়েত উল্লাহর ফোন নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া গেছে।
পুুলিশ ম্যানেজ করে চলছে হাজারের বেশি অবৈধ বাস : অনুসন্ধানে জানা গেছে, সায়েদাবাদ, দোলাইরপাড় ও কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া থেকে হাজারও বেশি অননুমোদিত বাস পদ্মা সেতু দিয়ে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় চলাচল করছে।
এর মধ্যে সোনালী পরিবহনের ঢাকা মেট্রো-ব-১২-২০১৪ বাসটির গাবতলী-বরিশাল রুটের পারমিট থাকলে সায়েদাবাদ থেকে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে চলাচল করে। ঢাকা-কুয়াকাটা রুটের মামুন এন্টারপ্রাইজের ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-৮৫২০ নম্বরের বাস চললে এটির রুট পারমিট নেই বলে জানা যায়।
বেনাপোল-যশোর-নড়াইল-ঢাকা রুটে নড়াইল এক্সপ্রেস নামে ঢাকা মেট্রো-ব-১২-২৩৯৬ নম্বরের বাসটি চলার অনুমতি নেই তবুও চলছে। পদ্মা ট্রাভেলসের ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-৮৯৪৭ নম্বরের বাস, শরীয়তপুর সুপার সার্ভিস লিমিটেডের ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-৯৫১৯, ঢাকা মেট্রো-ব ১২-২৩৯৬ নম্বরের বাসগুলো পদ্মা সেতুর দিয়ে চলার অনুমতি নেই। আর শরীয়তপুর সুপার সার্ভিস লিমিটেডের ঢাকা মেট্রো-ব-১২-১৩৯৩ নম্বরের বাসটির পদ্মা সেতু দিয়ে নয়, চলার অনুমতি আছে গাবতলী থেকে।
এসব রুটের বাস চলাচলের জন্য পুলিশের সঙ্গে অলিখিত চুক্তি করে নিয়েছেন বাসমালিকরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা-পিরোজপুর রুটের এক বাসমালিক অভিযোগ করে বলেন, ‘সরকার রুট পারমিট দেয়নি, এজন্য কিন্তু গাড়ি বন্ধ নেই।
সন্ধ্যার পর গাবতলী রুটের বাস পাটুরিয়া ঘাট দিয়ে না গিয়ে সব বাস বেড়িবাঁধ-পোস্তগোলা দিয়ে পদ্মা সেতু হয়ে বিভিন্ন রুটে যায়। তাদের পুলিশকে মাসে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে চলতে হয়।’
এ প্রসঙ্গে বক্তব্য নিতে বিআরটিএর চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীনকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। মুন্সীগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার সামশুল আলম সরকার সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ করলে হবে না। নির্দিষ্ট কেউ জড়িত থাকলে আমরা তদন্ত করে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। এমন তথ্য থাকলে যে কেউ প্রমাণসহ আমাদের জানাতে পারেন।