সারাদেশ
মারধরের সাহস ছিল না, তার হাতে ৭ খুনে বিস্ময়!
চাঁদপুরে সাত খুনের দায় স্বীকার করা ইরফান (২৬) তার আসল নাম আড়াল করে চাকরি নিয়েছিলেন। তা ছাড়া ধর্মান্তরিত হওয়া, বাবার মৃত্যু, ভাইয়ের সঙ্গে অন্তর্দ্বন্দ্ব, মায়ের মুসলমান হয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করা প্রভৃতি নানা বিষয়ে ইরফান পুলিশকে জানিয়েছেন। এসব ঘটনায় তার মানসিক সুস্থতা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে।
চাঁদপুর নৌপুলিশ সুপার কার্যালয়ের উপপরিদর্শক শেখ আব্দুস সবুর সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, রিমান্ডে ইরফান জানিয়েছেন, তার প্রকৃত নাম আকাশ মণ্ডল। তিনি ভৈরবে নৌযানে কাজ করার সময় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র পরিবর্তন করতে না পারায় আইডি কার্ডে এখনো আকাশ মণ্ডল নামটি রয়েছে।
ইরফান ওরফে আকাশকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে পুলিশ জানিয়েছে, এই যুবক তার পেছনের জীবনের ছোটখাটো অপরাধমূলক কাজকে আড়ালে রেখে ভালো ছেলে হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে চেয়েছিলেন। ইরফান নাম নিয়ে চাকরি নিয়েছিলেন জাহাজের খালাসি পদে; কিন্তু জাহাজের মাস্টারের আচরণে তিনি ক্ষিপ্ত হন।
যুবকের ভাষ্য, এমডি আল-বাখেরার মাস্টার তাকে জাহাজের ভাতা থেকে বঞ্চিত করতেন এবং নানাভাবে তার সঙ্গে অসদাচরণ করতেন। এ কারণে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু ধরা পড়ার ভয়ে জাহাজের সবাইকে খুন করতে চেয়েছিলেন। ভাগ্যক্রমে একজন বেঁচে গেছেন
তবে বেতন-ভাতা সম্পর্কে আল-বাখেরার মালিক মাহবুব মোর্শেদ ডাবলু বলেছেন, ‘তাকে বেতন-ভাতাসহ অন্য সুবিধা দেওয়া হতো না এমন অভিযোগ বানোয়াট।’ এ ঘটনায় তিনি ৮-১০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে হাইমচর থানায় মামলা করেছেন।
থানা পুলিশ ও স্থানীয়দের কাছে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর গ্রামে আকাশ মণ্ডল নামে পরিচিত এই যুবক। তার পিতা জগদীশ মণ্ডল মারা যাওয়ার পর পরিবারটির অধঃপতন শুরু হয়। তার মা অভাব-অনটন সহ্য করতে না পেরে তাদের দুই ভাইকে ফেলে এক মুসলিম যুবককে বিয়ে করে চলে যান। তার আগে এই নারী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাবা-মাকে হারানোর পর আকাশ ও তার ভাই মূলঘর গ্রামে নানা-নানির কাছে থাকছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের ব্যবধানে নানা-নানি মারা যান। এরপর আকাশের একমাত্র বড় ভাই বিধান মণ্ডল এক মুসলিম মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে ইসলাম ধর্মে গ্রহণ করে আবির হোসেন নাম নিয়ে আলাদা বসবাস শুরু করেন। সেই থেকে আকাশ একা।
তার প্রতিবেশী জিহাদুল ইসলাম ও মো. জুয়েল জানান, আকাশ ২০১৮ সালের দিকে একটি মুসলিম মেয়ের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে এলাকাছাড়া হন। ২০২২ সালের দিকে পুনরায় এলাকায় আসেন। কিন্তু ভাইয়ের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে আবার নিরুদ্দেশ হন। আকাশ অভাবের তাড়নায় এলাকায় মানুষের ক্ষেত ও পুকুর থেকে মাছ-শাক চুরি করলেও কাউকে মারধর করার মতো সাহস কখনো দেখাননি। সেই আকাশ সাতজনকে হত্যা করেছেন শুনে বিস্মিত এলাকাবাসী।
আকাশের সহোদর বড় ভাই আবির হোসেন বলেন, আমার নানা-নানি থাকত সরকারি জায়গায়, ঝুপড়ি ঘরে। তাদের মৃত্যুর পর আমিও সেখানেই থাকি। আমাদের পৈতৃক নিবাস মোল্লাহাট উপজেলার কোদালিয়া গ্রামে হলেও ছোটবেলায় বাবার মৃত্যুর পর মা ধর্মান্তরিত হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায় আমরা দুই ভাই নানা-নানির কাছেই বেড়ে উঠি। আমি ফলতিতা বাজারে সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রির একটা ছোট দোকান দিয়েছিলাম। সেখানে কাজের সময় আকাশ এক নারীর সঙ্গে প্রেমঘটিত ঘটনায় এলাকা ছাড়ে। এরপর আর ওই দোকান সেখানে বেশি দিন টেকেনি। নিরুদ্দেশ হওয়ার পর গত বছর এক দিনের জন্য আকাশ বাড়িতে আসলে তাকে বকাঝকা করে তাড়িয়ে দেই। এরপর থেকে আকাশ জাহাজে জাহাজে কাজ করে শুনেছি, কিন্তু আমার সাথে আর কোনো যোগাযোগ নেই।
জাহাজের নয়জন স্টাফের মধ্যে একজন নিখোঁজ ছিলেন। আকাশ ছিলেন নবম ব্যক্তি যাকে খুঁজছিল পুলিশ এবং পরে গ্রেপ্তার করেছে। অন্য আটজনের মধ্যে জুয়েল নামে একজন গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
জুয়েল আহত অবস্থায় চিরকুটে লিখে খুনিদের সম্পর্কে যেসব তথ্য দিয়েছিলেন, সেগুলো সব সঠিক নয় বলে জুয়েলের বরাতে নৌপুলিশ জানিয়েছে। চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক গঠিত চারজনের তদন্ত কমিটির সদস্য চাঁদপুর নৌপুলিশের অতিরিক্ত সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “জুয়েল পরে জানিয়েছেন, স্মৃতিশক্তি দুর্বল থাকায় ওই সময় ‘ইরফানের’ স্থলে ‘নিঃসার্থ’ নামটি লিখেছিলেন জুয়েল। মূলত ইরফানই ছিলেন ওই ব্যক্তি যে জুয়েলের গলায় জখম করেছিলেন।”
তিনি আরও বলেন, ‘ইরফান (আকাশ) নেশাগ্রস্ত ছিলেন কিনা তা নিয়ে কাজ চলছে। এছাড়া ইরফানের মানসিক কোনো সমস্যা আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি জানান, জাহাজটিতে কোনো সিসি ক্যামেরা ছিল না। সবাই ঘুমন্ত ছিলেন। ওই দিন সবাই কক্ষের দরজা খোলা রেখেছিলেন। দরজা টানা ছিল, তবে ছিটকানি আটকানো ছিল না। দরজা ভাঙ্গা না থাকায় বিষয়টি সহজভাবে বুঝা গেছে এবং জুয়েলের তথ্যেও তা নিশ্চিত হয়েছি।’
চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের আরএমও আসিবুল ইসলাম বলেন, জাহাজে ৭ খুনের প্রত্যেকটা মরদেহের ময়নাতদন্ত আমি করেছি। প্রত্যেককেই কানের একটু উপরে মাথায় কোপ দিয়ে মারা হয়েছে। ইরফান ওরফে আকাশ নেশাগ্রস্ত ছিলেন কি না সন্দেহ। সেটা এখনও যাচাই করা হয়নি।
একজন সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ কি এত মানুষকে এভাবে খুন করতে পারে? এমন প্রশ্নের উত্তরে চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের প্রধান এ এম ফরিদুজ্জামান বলেন, “ইরফানের মোটিভ কী ছিল এবং তিনি সাইকোপ্যাথ কি না তা জানা এক্ষেত্রে জরুরি। ২৬-২৭ বছর বয়সের যুবকরা এ ধরনের খুন করার ভালো আশঙ্কা থাকে। মূলত এই বয়সী যুবকদের যারা ‘অ্যান্টি সোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারের মানুষ’ তারা আইনকানুন মানতে চান না।”
এদিকে চাঁদপুর জেলা জজ কোর্টের এপিপি ইয়াসিন আরাফাত বলেন, ‘আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফান বিচারককে বলেছেন, মানুষ ভুল করে। আমিও ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দিন।’