রাজনীতি
রাজনীতিতে কি সক্রিয় হচ্ছেন খালেদা জিয়ার দুই পুত্রবধূ?
স্বাধীনতার পর থেকে ঘুরেফিরে নারী নেতৃত্বেই বেশি আস্থা রেখেছে দেশের মানুষ। একাত্তর পরবর্তীসময়ে ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলোর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আটটিতে দায়িত্ব পালন করেন নারী। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ছিলেন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবেও তিনি সংসদ সামলেছেন।
সত্তরোর্ধ্ব বয়সে দীর্ঘ কারাভোগ ও নানান শারীরিক জটিলতায় রাজনীতিতে কার্যত এখন নিষ্ক্রিয় এক সময়ের এই অগ্নিকন্যা। বড় ছেলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে নির্বাসিত। ৫ আগস্ট পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও তার দেশে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা পুরোপুরি কাটেনি। রাজনীতিতে তাই নজর এখন খালেদার দুই পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান ও সৈয়দা শামিলা রহমানের ওপর।
লন্ডনে উন্নত চিকিৎসা শেষে প্রায় চার মাস পর দেশে ফিরছেন খালেদা জিয়া। সঙ্গে আসছেন তার দুই পুত্রবধূ। তারেক রহমানকে নিয়েই দেশে ফেরার যে গুঞ্জন ছিল তা গুঞ্জনই রয়ে গেলো। এ অবস্থায় সম্ভাবনা আরও গাঢ় হচ্ছে দলের হাল ধরতে এই দুই নারী এগিয়ে আসবেন কি না তা নিয়ে।
জুবাইদা রহমান: দূরে থেকেও কাছে
২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শিক্ষা ছুটি নিয়ে লন্ডনে যান জুবাইদা রহমান। দ্বিতীয় দফা সময় বাড়িয়েও পেশায় চিকিৎসক জুবাইদা দেশে ফিরে কাজে যোগ না দেওয়ায় বরখাস্ত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যদিও বিএনপির বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ আছে। দীর্ঘ ১৭ বছর পর তিনি দেশে ফিরছেন। সিলেটের একটি রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠা জুবাইদাকে নিয়ে এবার বাড়তি আগ্রহ তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক মহলে।
তার বাবা প্রয়াত রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানী সম্পর্কে জুবাইদা রহমানের চাচা। তবে জুবাইদা রহমান রাজনীতি সচেতন হলেও এখনো সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। বিভিন্ন সময় বাবা মাহবুব আলীর মৃত্যুবার্ষিকী ও জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের দু-একটি প্রোগ্রাম ছাড়া তাকে প্রকাশ্যে দেখা গেছে খুব কম।
বিগত ১৭ বছর ‘ক্লিন ইমেজের’ হিসেবে খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানের বিকল্প হিসেবে জুবাইদা রহমান দলের হাল ধরবেন কি না তা নিয়ে চর্চা কম হয়নি। তবে এ বিষয়ে খালেদার পরিবারের পক্ষ থেকে কখনো কিছু স্পষ্ট করে বলা হয়নি। চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া এবার লন্ডনে গেলে অনেক দিন পর আবার সামনে আসেন জুবাইদা। সব সময় তাকে শাশুড়ির সঙ্গে দেখা গেছে। বাসায়ও শাশুড়িকে সেবা করেছেন। দেশে ফেরার সময়ও তিনি সঙ্গ দিচ্ছেন। তিনি বেশ কিছুদিন ঢাকায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে থাকবেন বলে জানিয়েছে দলীয় একটি সূত্র।
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পেছনে প্রধান অন্তরায়। সেক্ষেত্রে জিয়া পরিবার থেকে তারেক রহমানের পাশাপাশি জুবাইদা রহমানও সামনে আসবেন কি না সেটা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আছে নানাবিধ আলোচনা।
বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, দলের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বিশ্বাসযোগ্য ও শিক্ষিত নেতৃত্বের ওপর। জুবাইদা রহমান সে জায়গায় স্বতন্ত্র। লন্ডনে থেকেও দলের জন্য এটা তার অনুপস্থিত নয়, বরং এক ধরনের রাজনৈতিক প্রস্তুতি।
দলীয় কর্মীদের একটি অংশ মনে করছে, জুবাইদা রহমানের নেতৃত্বে এক ধরনের সৌম্য, শালীন ও উচ্চশিক্ষিত প্রোফাইল তৈরি হতে পারে, যা বিএনপিকে আধুনিক প্রজন্মের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে।
সৈয়দা শামিলা রহমান: আড়ালের ছায়া
আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী, দুই কন্যার মা। দলীয় রাজনীতিতে কখনোই সরাসরি যুক্ত হননি। তবে কোকোর মৃত্যুর পর খালেদা জিয়ার যত্নে তার অনুপম উপস্থিতি এবং পারিবারিক নির্ভরতার প্রতীক হয়ে ওঠা এটি এখন রাজনৈতিক মূল্য পাচ্ছে। তিনি দলের নেতৃত্বে আসবেন কি না, তা অনিশ্চিত। কিন্তু তার প্রতি নেত্রীর নির্ভরতাই তাকে রাজনৈতিক গুরুত্ব এনে দিচ্ছে।
সৈয়দা শামিলা রহমান সব সময় পর্দার আড়ালে থাকতেই পছন্দ করেছেন। রাজনীতির মাঠে তাকে দেখা যায়নি বললেই চলে। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার রাজনীতিতে আসা নিয়েও চলছে জোর চর্চা। নেতৃত্বে তার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ না থাকলেও পারিবারিক ঐতিহ্যের নিঃশব্দ উত্তরাধিকার তিনি বয়ে চলেছেন।
বিএনপির অভ্যন্তরে একটি অংশ মনে করে, সৈয়দা শামিলা রহমানের এই ত্যাগ ও বিশ্বাসযোগ্যতা তাকে ভবিষ্যতে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে।
বিএনপি ও নারী নেতৃত্ব
বিএনপি এখন এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে পুরোনো ধারা ভেঙে নতুন পথ খোঁজার চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। তারেক রহমান দীর্ঘদিন দূর প্রবাসে। খালেদা জিয়া কার্যত অক্ষম, মির্জা ফখরুল বা প্রবীণ নেতারা বারবার ব্যর্থ। এই প্রেক্ষাপটে পরিবারভিত্তিক নতুন নেতৃত্বের ভাবনা অপ্রত্যাশিত নয়।
মূলত ৯০ দশক থেকেই বিএনপি নারী নেতৃত্বে নির্ভরশীল। খালেদা জিয়া দুই বারের প্রধানমন্ত্রী। এখনো দলের চেয়ারপারসন। তারেক রহমান এখনো ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তার দেশে ফেরার বিষয়ে আলোচনা চললেও স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি। অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি বলেই মনে করছেন অনেকে।
কেউ কেউ মনে করেন, পরিচ্ছন্ন ইমেজের এই দুজন নারী যদি এগিয়ে আসেন, তবে সেটি হবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।
অদূর ভবিষ্যতে যদি বিএনপির নেতৃত্বে জুবাইদা রহমান ও সৈয়দা শামিলা রহমান– এই দুই নারীকে দেখা যায়, তবে সেটি হবে কেবল এক পরিবারের জয় নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারী নেতৃত্বের এক নতুন অধ্যায়। রাজনীতির ইতিহাসে আমরা বহুবার দেখেছি—পরিবারের দায়িত্বশীল নারীরাই সংকটকালে নেতৃত্ব দিয়েছেন, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। খালেদা জিয়াও এর বড় প্রমাণ।
যা বলছেন রাজনীতিকরা
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা তাদের রয়েছে। তবে এটা তাদের পারিবারিক সিদ্ধান্তের বিষয়। খালেদা জিয়ারও রাজনীতিতে আসার কথা ছিল না। কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতিতে তিনি দল ও দেশের হাল ধরেছেন। বাংলাদেশ এখনো তো তাই নেতৃত্বশূন্যতা। এই পরিস্থিতিতে ওনারা যদি পারিবারিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এগিয়ে আসেন তাহলে নেতাকর্মীরা আনন্দিত হবেন। বিষয়টি জানার জন্য কর্মীদের অধীর আগ্রহ রয়েছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘খালেদা জিয়া ফিরবেন, সঙ্গে তাদের দুই পুত্রবধূ ফিরবেন। তাদের নিরাপত্তা কেমন হবে তা নিয়ে আমাদের সিকিউরিটি মিটিং হয়েছে। দলের পক্ষ থেকে একটা বড় রিসিপশনের চেষ্টা করছি। তাদের নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আপাতত এটুকুই। পরে কী হবে সেটি জানতে পারবেন।’
আমার বাংলাদেশ এবি পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘বিএনপি যে ধরনের দল তাতে ডা. জুবাইদা রহমান ও সৈয়দা শামিলা রহমান আনুষ্ঠনিকভাবে রাজনীতিতে যুক্ত না হলেও বাংলাদেশের রাজনীতি ও বিএনপিতে তারা দুজন প্রাসঙ্গিক এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিগণিত হবেন বলে আমি মনে করি।’
তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিচিতির কারণে ডা. জুবাইদা রহমানের এমনিতেই একটা ইতিবাচক ইমেজ রয়েছে। আরাফাত রহমান কোকোর আকস্মিক মৃত্যু এবং পরবর্তীসময়ে অসুস্থ শাশুড়ি খালেদা জিয়ার পাশে তার নিবিড় পরিচর্যার দায়িত্ব পালনের কারণে তার প্রতিও বিএনপি নেতাকর্মীদের শ্রদ্ধাবোধ আছে। আমার মনে হয় বিএনপিতে কোনো কারণে নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি হলে তারা সেটা পূরণ করতে সক্ষম হবেন।’