বরিশাল
দুর্গাসাগর দিঘিতে সাড়ে ৩০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী পুণ্যস্নান উৎসব
বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার ঐতিহাসিক দুর্গাসাগর দিঘিতে সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সাড়ে ৩০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী পুণ্যস্নান উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। হিন্দুশাস্ত্র মতে চৈত্রের অশোকা অষ্টমী তিথির লগ্ন অনুসারে শনিবার ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দুর্গাসাগর দিঘিতে ওই স্নান উৎসব চলে। এসময় হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় দিনভর মুখরিত হয় গোটা এলাকা। স্নান উৎসবকে ঘিরে দিঘির পাড়ে পূজাপাঠ চক্র এবং পাশ্ববর্তী চন্দ্রদ্বীপ হাইস্কুল ও কলেজ মাঠে দিনব্যাপী মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
সনাতন হিন্দু ধর্মবিশ্বাস মতে প্রতিবছর চৈত্রমাসের অশোকা অষ্টমী তিথিতে নিজের অতীত জীবনের পাপ-পঙ্কিলতা ধুয়েমুছে নতুন পরিশুদ্ধ জীবন লাভের আশায় বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা ইউনিয়নে অবস্থিত ঐতিহাসিক দুর্গাসাগর দিঘিতে পুণ্যস্নান করতে আসেন সনাতন ভক্ত ও পুণ্যার্থীরা। এসময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দিনভর প্রায় লাখো মানুষের সমাগম ঘটে এখানে। প্রায় সাড়ে তিনশো বছর ধরে চলছে এই রেওয়াজ। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এবার স্নান উৎসবে এয়ারপোর্ট থানা পুলিশ, র্যাব, আনসার, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকের পাশাপাশি শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করেছে সেনাবাহিনী। সার্বিক ব্যবস্থাপনায় খুশি স্নানে আসা ভক্তরা।
গোপালগঞ্জ থেকে আসা সীমা রাণী দাস বলেন, প্রতিবছরই এই দুর্গাসাগর দিঘিতে আমার পরিবারের সবাইকে নিয়ে স্নান করতে আসি। এবার মনের মধ্যে কিছুটা ভয় এবং অজানা আশঙ্কা কাজ করলেও এখানে আসার পরে সেটা দূর হয়েছে। সেনাবাহিনী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথেষ্ট সদস্য উপস্থিত দেখে আমাদের ভয় কেটে গেছে। এছাড়া এবারের সার্বিক ব্যবস্থাপনাও ভালো ছিল। অভিন্ন অনুভূতি প্রকাশ করেছেন বরগুনা থেকে আসা সনাতন ভক্ত অশোক কুমার বিশ্বাস।
স্নান ও মেলা পরিদর্শনে এসে বাবুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আহবায়ক সুলতান আহমেদ খান বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে দুর্গাসাগরে আসা হিন্দু ভাইবোনদের সাথে কথা বলেছি। সার্বিক ব্যবস্থাপনায় এবার তারা যথেষ্ট খুশি। অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা এবং শৃঙ্খলা রক্ষায় বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা এবং আমাদের দলীয় স্বেচ্ছাসেবকরা আয়োজকদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছি। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার, এই নীতিতে সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়তে চাই আমরা।’
বাবুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ফারুক আহমেদ জানান, ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর দিঘি বাবুগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত জেলা প্রশাসনের একটি পর্যটন স্পট। প্রতিবছর এখানে সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অশোকা অষ্টমীর স্নান উৎসব ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। তাদের এই ধর্মীয় অনুষ্ঠান নির্বিঘ্ন এবং নিরাপদ করতে উপজেলা প্রশাসন বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। স্নানে আসা পুণ্যার্থীদের নিরাপত্তায় ওসি জাকির শিকদারের নেতৃত্বে এয়ারপোর্ট থানা পুলিশ ছাড়াও র্যাব এবং সেনাবাহিনীর একটি করে টিম সেখানে সার্বক্ষণিক কাজ করেছে। এছাড়াও স্নানের সময় যাতে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে সেজন্য ডুবুরিসহ ফায়ার সার্ভিসের একটি সুসজ্জিত দল সেখানে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। স্নানের আগে ও স্নান উৎসব চলাকালে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিদর্শন, সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে মনিটরিং এবং সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা সার্বক্ষণিক তদারকি করা হয়েছে। ফলে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি সত্যেও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই সনাতন ধর্মালম্বীদের এই ধর্মীয় উৎসব সম্পন্ন হওয়ার তারা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
স্নান উৎসব ও মেলার আয়োজক কমিটির সভাপতি এবং চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের শেষ রাজা সতীন্দ্র নারায়ণ রায়ের ছেলে রাজা দিলীপ কুমার রায় বলেন, ‘বরিশাল ছিল প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। এর রাজধানী ছিল বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশায়। আমার পূর্বপুরুষ চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের পঞ্চদশ রাজা শিব নারায়ণ রায় ১৭৮০ সালে এই বিশালাকৃতির দিঘিটি খনন করেন। চৈত্রের খরা মৌসুমে রাজ্যের বিভিন্ন জলাশয় শুকিয়ে গেলে প্রজাদের পানির অভাব দূর করতে তার স্ত্রী রাণী দুর্গামতি একটি বড় দিঘি খননের পরামর্শ দেন। এই প্রস্তাব রাজার পছন্দ হলে রাণী দুর্গামতি যতদূর হেঁটে ঘুরে আসতে পারবেন ততদূর এলাকা নিয়ে একটি দিঘি খনন করার নির্দেশ দেন রাজা। এ কারণে রাণীর নামানুসারে এই দিঘির নাম হয় দুর্গাসাগর দিঘি। এরপর থেকে এই দিঘিতেই অশোকা অষ্টমীর পূজা ও ধর্মীয় পূণ্যস্নানের রীতি পালন হয়ে আসছে।’
রাজা দিলীপ কুমার রায় আরও বলেন, এবারের পরিবর্তিত পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যেহেতু সারাদিনে এখানে লাখের বেশি লোকের সমাগম হয় সেহেতু তাদের নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি দিঘির চতুর্দিকে সিসিটিভি ক্যামেরা এবং প্রায় ৫ শতাধিক স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক রাখা হয়েছে। এছাড়াও স্নানের পরে মহিলাদের কাপড় পাল্টানোর জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৩০০ বছর ধরে এই পুণ্যস্নান উৎসবে স্থানীয় মুসলিমসহ সকল ধর্মের মানুষ আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করে আসছেন। সেজন্য আমরা চির কৃতজ্ঞ।’