সারাদেশ
রাশিয়ায় নিহত ইয়াসিনের মা
আমার ছেলের লাশটা আইন্ন্যা দেন, শেষবারের মতো দেখবার চাই
‘বুকভরা আশা লয়্যা ছেলেকে বিদেশ পাঠাইছিলাম। ভাবছিলাম, সংসারে অভাব-অনটন দূর অইবো। এহন আমার ছেলেই মারা গেছে। আমার ছেলের লাশটা আমার কাছে আইন্ন্যা দেন। আমি আমার ছেলের মুখটা শেষবারের মতো একনজর দেখবার চাই।’
শনিবার (৫ এপ্রিল) দুপুরে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের মরিচালি গ্রামের বাড়িতে আহাজারি করতে করতে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ায় মারা যাওয়া ইয়াসিন মিয়া শেখের মা ফিরোজা খাতুন।
তিনি বলেন, ‘১০ দিন আগে ছেলের লগে কথা হইছে। এরপর থাইক্যা আর যোগাযোগ নাই। খবর পাইছি মারা গেছে। আমি কই যাইয়াম, কী করবাম, কিছুই বুঝতেছি না। সরকার আমার ছেলার লাশটা আইন্ন্যা দিক।’
নিহত ইয়াসিনের চাচা আব্দুল হাকিম জানান, পরিবারকে স্বচ্ছল করবে এমন আশায় ১৫ লাখ টাকা খরচ করে ইয়াসিনকে রাশিয়ায় পাঠানো হয়। ধারদেনার টাকাগুলো এখনো পরিশোধ হয়নি। ইয়াসিন এরইমধ্যে লক্ষাধিক টাকা পাঠিয়েছেন। ঈদের পর ১০ লাখ টাকা পাঠানোর কথা ছিল। গত ২৬ মার্চ ইয়াসিনের সঙ্গে তার মায়ের শেষ কথা হয়। রাশিয়ায় থাকা ইয়াসিনের বন্ধু মেহেদী ঈদুল ফিতরের পরদিন (মঙ্গলবার) বিকেলে মারা যাওয়ার তথ্য জানান। এরপর থেকেই ইয়াসিনের মায়ের আহাজারি থামছে না। তার বড় ভাই রুহুল আমিন পাগলপ্রায়। এখন ইয়াসিনের মরদেহের কী অবস্থা, তা নিয়ে কোনো তথ্য পাচ্ছেন না।
বড় ভাই রুহুল আমিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের লোকজন এসে আমাদের বাড়িতে এসে সান্ত্বনা দিচ্ছে। বলছে, লাশ ফেরত আনার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু এই চেষ্টা কতদিন লাগবে, তা আমরা জানি না। আমাদের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা শেষ হয়ে গেছে। লাশ ফেরত আনতে অন্তর্বর্তী সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
একই গ্রামের বাসিন্দা ময়মনসিংহ উত্তর জেলা বিএনপির সিনিয়র সদস্য অ্যাডভোকেট নূরুল হক বলেন, ‘ইয়াসিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরি পেতে অনেক চেষ্টা করেছিলেন। তাকে প্রাথমিকভাবে সিলেকশনও করা হয়েছিল। কিন্তু চূড়ান্তভাবে নিয়োগ দেওয়ার আগে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের কর্মী না হওয়াসহ অন্য দলের (ছাত্রদল) রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় নিয়োগ পায়নি। এ অবস্থায় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্নপূরণ করতে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে চুক্তিভিত্তিক যোদ্ধা হিসেবে ইউক্রেন যুদ্ধে যোগ দেন ইয়াসিন। সেখানেই মারা মারা গেলেন তিনি।’
এ বিষয়ে গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাজ্জাদুল হাসান বলেন, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ৯ বছর আগে মারা যান ইয়াসিনের বাবা আব্দুস সাত্তার শেখ। চার ভাইবোনের মধ্যে দুজন আগেই মারা গেছেন। মা আর বড় ভাই রুহুল আমিনকে নিয়ে ছিল ইয়াসিনের সংসার। ইয়াসিন ঢাকার পল্লবীর সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজে ২০২২-২৩ সেশনের ডিগ্রির শিক্ষার্থী ছিলেন।
অভাব-অনটনের সংসারের হাল ধরতে কোম্পানিতে চাকরি করতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাশিয়ায় পাড়ি দেন ইয়াসিন। সেখানে গিয়ে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে চাকরির সুযোগ হয়। বাবার আর নিজের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগটি হাতে নেন। ২২ ডিসেম্বর পরিবারের লোকজন জানতে পারেন ইয়াসিনকে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে পাঠানো হয়েছে।
যুদ্ধে যাওয়ার আগেই মস্কো থেকে প্রায় ১১ হাজার কিলোমিটার দূরের ওই কোম্পানিতে তিন মাস চাকরি করেছিলেন ইয়াসিন। চলতি বছরের ২৭ মার্চ ইউক্রেনের মিসাইল হামলায় থেমে যায় সেই স্বপ্নের যাত্রা। একটি বোমা এসে পড়ে শরীরে। সঙ্গে সঙ্গেই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় ইয়াসিনসহ তার চার সহযোদ্ধার দেহ। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। ঈদুল ফিতরের পরদিন বিকেলে ইয়াসিনের এক সহযোদ্ধা ইয়াসিনের মৃত্যুর খবর জানায় তার পরিবারকে।



