বরিশাল
বরিশাল মৎস্য অফিসের কর্মচারীর নেতৃত্বে অভিযান, ঘুস নিয়েই ম্যানেজ!
নিজস্ব প্রতিবেদক : বরিশাল জেলা মৎস্য দপ্তরের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী বিজয় কর্মকর্তার রূপে আবির্ভুত হয়েছেন। তার কর্ম দপ্তরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কথা থাকলেও এবার তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে অবৈধ মাছ ধরতে টিম নিয়ে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। দপ্তরের নিম্নপদস্থ কর্মচারী বিজয় অবৈধ মাছ ধরতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েছেন ঘুস কেলেংকারিতে। ঈদের দিন সোমাবার রাতে তিনি দুই সাগরেদ রুহুল এবং মালেককে নিয়ে শহরের সাগরদি ডোস্টপাম্পে হানা দিয়ে সেখান থেকে কয়েকজন ব্যবসায়ীর অন্তত ১৭ ব্যারেল অবৈধ মাছ আটক করেন। এবং মাছ জব্দের ভয়ভীতি দেখিয়ে একপর্যায়ে তিনি দুই সাগরেদের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের সাথে সন্ধিচুক্তি করার পরামর্শ দেন। বিজয়ের নির্দেশনার আলোকে দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মচারী রুহুল এবং মালেক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্ধ লক্ষ টাকা নিয়ে সেই অবৈধ মাছ ছেড়ে দিয়েছেন, যা নিয়ে এখন মৎস্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে নানান আলোচনা শোনা যায়। এবং একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী অভিযান চালাতে পারেন কী না এনিয়ে একগুচ্ছ প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।
আলোচিত কর্মচারী বিজয় ঘুস নিয়ে মাছ ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করলেও প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সোমবার রাত ৯টার দিকে বিজয়ের নেতৃত্বে রুহুল এবং মালেক সাগরদি ডোস্টপাম্পে হানা দেন। এবং সেখান থেকে তালতলী ও পোর্টরোডের ব্যবসায়ী নাসির মোল্লাসহ আরও কয়েকজনের ১৭ ব্যারেল মাছ তিনি আটক করেন।
কিন্তু বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, আটকের পর মাছগুলো বিজয় সরাসরি মৎস্য অফিসে না নিয়ে গিয়ে পাম্পটির বিপরিত পাশে গলির ভেতরে ঢুকে ব্যবসায়ীদের সাথে দেনদরবার শুরু করে দেন। এবং অবৈধ মাছ নিতে হলে ৫০ হাজার টাকা উৎকোচ চাওয়া হয়। এই ঘুস না দিয়ে মাছ নেওয়া সম্ভব না জানিয়ে বিজয় ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে গেলেও তার দুই সাগরেদ ঠিকই ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে রাখেন। এবং দেনদরবার শেষে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিজয়ের নির্দেশনার আলোকে ২০ হাজার টাকা বাণিজ্য করে। এই পুরো ঘটনাটি জনৈক এক প্রত্যক্ষদর্শী মুঠোফোনে ভিডিও ধারন করে রেখেছেন, যা এ প্রতিবেদকের হাতেও এসেছে।
সূত্র জানিয়েছে, কর্মচারী বিজয় এর আগে বরিশাল মৎস্য অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাসের সাগরেদ ছিলেন। বিমল চন্দ্র টানা ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে বরিশালে কর্মরত ছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের রেণুপোনা ও জাটকাসহ অবৈধ মাছ পাচারের সুযোগ করে দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে। সরকার পরিবর্তনের পরে এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে শাস্তিস্বরূপ নওগাঁয় বদলি করা হয়েছে।
বিমলকে শাস্তিমূলক বদলি করা হলেও তার সঙ্গী বিজয় এখন দপ্তরের বড় কর্তা বনে গেছেন। কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিজয় দপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তা রিপন কান্তির সাথে সখ্যতা গড়ে দুর্নীতিবাজ বিমলের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। সেক্ষেত্রে তিনি সিনিয়র একাধিক কর্মকর্তার নির্দেশনাও উপেক্ষা করাসহ ঘুস কেলেংকারিতে জড়িয়ে পড়েছেন, যেমনটি হয়েছে সোমবার রাতে ডোস্টপাম্পে।
তবে সোমবার রাতে ডোস্টপাম্পে ব্যবসায়ীদের সাথে বিজয়ের কি হয়েছে, এই তথ্য জানা নেই বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কান্তি। তিনি জানান, সোমবার ডোস্টপাম্পে অবৈধ মাছ আটক হয়েছে, খবর পেয়ে বিজয়কে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখান থেকে কোনো মাছ জব্দ করতে পারেনি।
তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, মৎস্য বিভাগের কর্মচারী বিজয় ডোস্টপাম্পে দুই সাগরেদ নিয়ে প্রবেশ করেই ব্যারেলভর্তি মাছ তল্লাশি শুরু করে দেন। এবং ব্যারেলে চাপিল-জাটকা ইলিশ দেখতে পেয়েই ব্যবসায়ীদের কাছে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন।
ব্যবসায়ীদের একজন নামপ্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করেছেন, ডোস্টপাম্প থেকে মাছের ব্যারেলগুলো রাজধানী ঢাকার যাত্রীবাড়ির পরিবহনে পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু এর আগে মৎস্য অফিসের কর্মচারী বিজয়ের নেতৃত্বে প্রথমে রুহুল এবং মালেক এসে তা আটকে দেন। এবং মাছ ছাড়িয়ে নিতে হলে ৫০ হাজার টাকা ঘুস চাওয়া হয়, যার দেনদরবার করা হয়েছে বিপরিত পাশে গলির ভেতরে একটি বালুর মাঠে।
ব্যবসায়ী জানান, বিজয় ৫০ হাজার টাকা নিয়ে মাছগুলো ছেড়ে দিতে রুহুল ও মালেককে নির্দেশনা দিয়ে চলে যান। পরবর্তীতে দুই সাগরেদ ওই এলাকার শ্রমিক রাসেলের মধ্যস্থতায় ব্যবসায়ীদের ফোন করে ডেকে নেন। একপর্যায়ে ২০ হাজার টাকা ঘুস দিয়ে মাছগুলো ছাড়িয়ে নিতে বাধ্য হন ব্যবসায়ীরা।
একাধিক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছেন, রিপন কান্তির আস্কারায় বিজয় এখন দুর্নীতিবাজ সাবেক কর্মকর্তা বিমল চন্দ্র দাসের দেখানো পথেই হাঁটছেন। তিনি বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে ফোন করে ঘুস দাবি করেন। আবার কখনও কখনও তিনি ঘটনাস্থলে দুই সাগরেদ রুহুল এবং মালেককে নিয়ে গিয়ে কর্মকর্তা রিপন কান্তির পরিচয় দিয়ে নিজেই ঘুস দাবি করেন।
সাগরেদদের একজন রুহুলের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথমে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যুক্তি-তর্কে ব্যর্থ হয়েছেন। পরে স্বীকার করেছেন, ডোস্টপাম্পে তাদের কোনো অভিযান না থাকলেও বিজয়ের নেতৃত্বে সেখানে গিয়েছিলেন। এবং বেশ কয়েক ব্যারেল অবৈধ মাছও ধরেছিলেন, কিন্তু তা জব্দ করার কোনো নির্দেশনা ছিল না।
তাহলে রাসেলের মাধ্যমে ফোনাফোনি করে যে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা নেওয়া হলো এই বিষয়ে জানতে চাইলে রুহুল তালগোল পাকিয়ে ফেলেন এবং পরিশেষে ফোনসংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
মজুরিভিত্তিক কর্মচারী রহুলের এমন বক্তব্যই স্পষ্ট করে দেয় যে সোমবার রাতে অবৈধ মাছ নিয়ে ডোস্টপাম্পে কি হয়েছে এবং মৎস্য দপ্তরের ঘুসখোর কর্মচারী বিজয়ের কর্তকর্তা হয়ে ওঠার নিদর্শন।
তবে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ডোস্টপাম্পে সোমবার রাতে যাওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেছেন, কারা টাকার লেনদেন করেছেন তা সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী কি অভিযানে নেতৃত্বে দিতে পারেন কি না এমন প্রশ্ন করা হলো তিনি ভরকে যান এবং পরিশেষে মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। এর আগে তিনি বিষয়টি নিয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কান্তির সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।
সবিস্তার জানানোর পরে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিস্ময়প্রকাশ করেছেন। এবং তিনি জানান, সোমবার রাতে সংবাদ পেয়ে ডোস্টপাম্পে বিজয়কে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেখানে কি হয়েছে, তা জানা নেই। বিস্তারিত জানার পরে ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে, মন্তব্য করেন তিনি।
চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী অভিযান কি করে চালাতে পারেন, এসব অভিযান করতেতো পুলিশ এবং উপরস্থ কর্মকর্তা থাকা বাধ্যতামূলক এমন প্রশ্নে জেলা মৎস্য বলছেন, প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মে গেলে এমনটা করতে হয়। তাহলে কর্মচারী বিজয় যেটা করেছে, সেটা যে অবৈধভাবে করেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কর্মচারী বিজয় সাবেক কর্মকর্তা বিমলের পথে হাঁটার বিষযটিকে মৎস্য দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা নেতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তাদের অভিযোগ, বিজয় জেলা কর্মকর্তার নাম ভাঙিয়েও অপকর্ম করছে, সব কিছু জানার পরেও তার লাগাম টানা সম্ভবপর হচ্ছে না, যা হতাশাজনক এবং উদ্বেগের বলে মনে করা হচ্ছে।
তাছাড়া সোমবার রাতে ডোস্টপাম্পে কি হয়েছে বা বিজয়ের নেতৃত্বে দুই সাগরেদ রুহুল এবং মালেক মাছ আটকে যে ঘুস বাণিজ্য করেছেন, আলামত আশপাশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠনসমূহের সিসি ক্যামেরাতেও ধারন হয়েছে।
এখন এই দুর্নীতিবাজ কর্মচারী রুহুলের বিরুদ্ধে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কি ব্যবস্থাগ্রহণ করবেন সেটাই দেখার অপেক্ষা।’