খেলাধুলা
মাঠ থেকে লাইফ সাপোর্ট—সকাল থেকে তামিমের সঙ্গে যা যা ঘটেছে
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের (ডিপিএল) অষ্টম রাউন্ডের ম্যাচ খেলতে সকালে বিকেএসপিতে গিয়েছিলেন মোহামেডান অধিনায়ক তামিম ইকবাল। নির্ধারিত সময় সকাল ৯টায় বিকেএসপির তিন নম্বর মাঠে শাইনপুকুরের বিপক্ষে ম্যাচটিতে টসও করেন তামিম।
এরপরের মুহূর্তগুলোতে বলতে গেলে ‘মৃত্যুর দুয়ার’ থেকে ফিরে এসেছেন। বুকে ব্যথা নিয়ে পাশ্ববর্তী কেপিজি স্পেশালাইজড হাসপাতালে যান। পরে জানা যায়, দুবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে তামিমের। হার্টে ব্লক ধরা পড়ার পর রিংও পরানো হয়েছে।
সর্বশেষ জানা যাচ্ছে, কিছুটা উন্নতির দিকে তামিম ইকবালের শারীরিক পরিস্থিতি। এরই মধ্যে জ্ঞান ফিরেছে জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়কের। পরিবারের সদস্যদের ডাকে সাড়াও দিয়েছেন। তবে এখনও পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত নন তিনি। আরও ৪৮ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে রাখছেন কর্তব্যরত চিকিৎসকরা।
ডিপিএলের ম্যাচে শাইনপুকুর অধিনায়ক রায়ান রাফসান রহমানসহ টস করতে মাঠে নামেন তামিম ইকবাল। পাশে ছিলেন ম্যাচ রেফারি দেবব্রত পাল। এ সময় তার সঙ্গে খানিক আলাপও হয় তামিমের। এদিন অবশ্য টস ভাগ্য পাশে পাননি। টস হেরে শুরুতে ফিল্ডিংয়ে নামে মোহামেডান। তবে দলের সঙ্গে মাঠে আর নামা হয়নি তামিমের।
বুকে ব্যথা নিয়ে ড্রেসিং রুমে ফিরেই বলছিলেন, অস্বস্তির কথা। এরপর অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকে। তামিমের অবস্থা দেখে দ্রুত হেলিকপ্টার ব্যবস্থা করা হয় ঢাকার এভারকেয়ার হসপিটালে নিয়ে আসার লক্ষ্যে। সব ঠিকঠাক করে হেলিকপ্টারে ওঠার আগ মুহূর্তে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। তখন সিদ্ধান্ত পাল্টে স্থানীয় কেপিজি বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তামিম ইকবালের আকস্মিক অসুস্থতার খবরে মুহূর্তেই নানা খবর ছড়িয়ে পড়ছিল। উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় ছিল গোটা দেশ। সবার নজর ছিল সাভারের সেই হাসপাতালের দিকে। যেখানে ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন দেশের ক্রিকেটের অন্যতম সেরা এই তারকাকে সারিয়ে তুলতে। কিছুক্ষণ পর তামিমের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে এডমিনের বরাতে করা এক বার্তায় তার অসুস্থতা নিয়ে বিস্তারিত জানানো হয়।
ঘটনার বর্ণনায় জানানো হয়, সকালে টসের পর হালকা বুকে ব্যথা অনুভব করলে বিষয়টি দ্রুত দলের ফিজিও ও ট্রেইনারকে জানান তামিম। প্রাথমিকভাবে গ্যাস্ট্রিকজনিত সমস্যা মনে হওয়ায় তিনি গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ গ্রহণ করেন। তবে কিছুক্ষণ পরও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় সতর্কতার অংশ হিসেবে নিকটতম হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং চিকিৎসা শেষে তিনি বিকেএসপিতে ফিরে
এরপর শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটলে দ্রুত বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবা হয়। দলের (মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব) ম্যানেজার শিপন ভাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করা হয়, যাতে দ্রুত উন্নত চিকিৎসার জন্য স্থানান্তর করা সম্ভব হয়। তবে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়লে তাকে ফের নিকটতম কেপিজে হাসপাতাল ও নার্সিং কলেজে নেওয়া হয়। সেখানে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার হার্টে ব্লক ধরা পড়ে। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুত এনজিওগ্রাম করা হয় এবং রিং পরানো হয়। বর্তমানে তিনি কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন।
বিকেএসপির স্বনামধন্য কোচ মন্টু দত্ত সকাল থেকেই দেখেছেন তামিমের বিধ্বস্ত শারীরিক অবস্থার পুরোটা। শোনান সকাল থেকে কী হয়েছিল তামিমের সঙ্গে। শাইনপুকুরের বিপক্ষে ম্যাচের পর একবার হাসপাতালে এসেছিলেন তিনি, ‘সে (তামিম ইকবাল) ভর্তি হয়। ডাক্তাররা তাকে ছাড়বে না বলে। সে নিজ থেকেই শিপন (মোহামেডান ম্যানেজার) ফোন করে বলে আমার জন্য একটা এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা করো। আমি ঢাকাতে চলে যাবো। আমাকে শিপন তখন বলে একটা হেলিকপ্টার নামানোর ব্যবস্থা করেন। তখন ১ নম্বর মাঠে হেলিকপ্টার নামানোর ব্যবস্থা করি।’
যখন হেলিকপ্টার নামানো হয় তখন তামিম বুঝতে পেরে এবং অনেকটা জোর করেই অ্যাম্বুলেন্সে চেপে বিকেএসপি ফেরত যান। মন্টু দত্ত জানান, বিকেএসপিতে আরেকবার ফেরার পথে কেপিজি হাসপাতালেরই এক ডাক্তার তার সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু সেখানে যাবার পর তার পালস পাওয়া যায়নি।
মন্টু দত্ত এরপর জানান, ‘এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তুলতে যাব, তার কোনো পালস পাওয়া যায় না। দশ মিনিট সেখানে চাপ দেয়ার পর কিছুটা পালস পেলে তাকে আবার কেপিজি হাসপাতালে আনা হয়। ওই মুহূর্তে ডাক্তার বলছিল আমরা যদি তামিমকে এয়ারে তুলি, হয়ত আমরা তামিমকে আর ফিরে পাবো না। তারপর এখানে নিয়ে আসার পর তাকে আবার ইমার্জেন্সিতে ভেতরে ঢোকানো হয়। তড়িঘড়ি করে অপারেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ব্লক ধরা পড়ে।’
তামিম ইকবালের সবশেষ শারীরিক অবস্থা নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেছেন সাভারের কেপিজি বিশেষায়িত হাসপাতালের (পূর্বের ফজিলাতুননেসা মুজিব হাসপাতাল) ডিরেক্টর ড. রাজিব। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই জানি তামিম ইকবাল ভাই আজ সকাল বেলা অসুস্থ হয়েছিলেন। ৯টা-সাড়ে ৯টার দিকে বিকেএসপিতে অসুস্থ হন। এখানে নিয়ে আসার পর চিকিৎসা শুরু হয়। পরবর্তীতে আমরা চিন্তা করি ঢাকায় নিয়ে যাওয়া যাবে কিনা। কিন্তু উনার অবস্থা গুরুতর হয়ে যায়, এই গুরুতর অবস্থায় আবার আমাদের কাছে আসেন। গুরুতর অবস্থা থেকে যত রকম চিকিৎসা দরকার সবই করা হয়েছে। আল্লাহর রহমতে উনার অবস্থা অনুকূলে আছে।’
তিনি যোগ করেন, ‘উনার একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, এটার জন্য এনজিওগ্রাম করে এনজিওপ্লাস্টি ও স্টেন্ট করা হয়েছে। স্টেন্টিং খুব স্মুথ ও কার্যকরভাবে হয়েছে। এটা করেছেন ডা. মনিরুজ্জামান মারুফ। উনার ব্লকটা পুরোপুরি চলে গেছে এখন। এখনো উনি পর্যবেক্ষণে আছে, গুরুতর অবস্থা এখনো কাটেনি। এটা একটু সময় লাগবে। সবাই উনার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছি।’
এর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল-ক্লিনিক শাখা) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, তিনি (তামিম ইকবাল) একিউট এমআই বা হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন, যার ফলে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। প্রাথমিকভাবে প্রাইমারি পিসিআই করা হয় এবং এলসিএক্স নামের ধমনীতে ব্লক ধরা পড়ে। তাই জরুরিভিত্তিতে সেখানে স্টেন্ট (রিং) বসানো হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্লকেজ কমে গিয়ে হার্টে রক্তপ্রবাহ বাড়ে, যা তাকে দ্রুত সুস্থ হতে সহায়তা করবে।
তামিমের শারীরিক অবস্থার আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে জানা গেছে। জ্ঞান ফিরেছে এই ওপেনারের। অসুস্থতার খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথাও বলেছেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক। তামিমের সবশেষ অবস্থা নিয়ে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বিসিবির প্রধান চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরী বলেন, ‘এখনো পর্যন্ত তামিমের শারিরিক অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে৷ যদিও কতৃপক্ষ ২৪ ঘন্টা অবজারভেশনে রাখেন সেটাই স্বাভাবিক নিয়ম। হাসপাতাল কতৃপক্ষ যথেষ্ট আন্তরিক।’
তামিমের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও এখনো পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত নন তিনি। তাই ২৪ ঘণ্টার অবজারভেশনে রাখা হয়েছে। তবে ডাক্তাররা আশাবাদী এক দিনের মধ্যে অবস্থার আরো উন্নতি হবে। দেবশীষ বলেন, ‘আমরা খুবই আশাবাদী যে একদিনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উন্নতি দেখতে পাবো।’