বরিশাল
চরবাড়িয়ায় মাদকের ডিপো খুলেছেন রাসেল মেম্বর, বাসার অদূরে সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে নজরদারি
নিজস্ব প্রতিবেদক : সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের লামছড়ি সড়কের মধ্যবর্তি স্থানের বাসিন্দা ত্রিশোর্ধ্ব এই যুবক আওয়ামী লীগের গোটা শাসনামলে কাউনিয়া থানা পুলিশকে মাসোহারা দিয়ে বেপরোয়া মাদক বাণিজ্য চালিয়ে আসলেও একাধিকবার গ্রেপ্তারসহ ডজনখানেক মামলার আসামি হতে হয়। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-আন্দোলন এবং সরকার পতনের পরে আইনশৃঙ্খলা নির্লুপ্ত হয়ে গেলে রাসেল হাওলাদার ওরফে রাসেল মেম্বর একধরনের মাদকের ডিপো খুলে বসেছেন। সড়কপথে মাদক আনতে গেলে আইনি ঝুটঝামেলায় পড়তে হয় এবং হয়রানিও হতে হয়। তাই তিনি মাদক মজুতের জন্য নিরাপদ পথ হিসেবে নৌরুটকে বেচে নিয়েছেন।
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, কীর্তনখোলা এবং আড়িয়াল খাঁ দুটির নদীর মধ্যবর্তি জনপদে রাসেল মেম্বরের বাড়ি, সে কারণেই তিনি নৌপথে কোনো প্রকার ঝইঝামেলা বিহীন মাদক নিয়ে আসতে সক্ষম হচ্ছেন। এবং পরবর্তীতে এই মাদক বরিশাল শহরসহ জেলা-উপজেলাগুলোর খুচরা বিক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করছেন। তবে রাসেল এখন মাদক বিক্রির ক্ষেত্রে কৌশল কিছুটা বদলেছেন, দিন অপেক্ষা রাতের বেলা বেচা-বিক্রি বেশি করছেন। জানা গেছে, রাসেলের এই মাদক বাণিজ্যে তার স্ত্রী শিরিন বেগমসহ অন্তত অর্ধশত কিশোর-যুবক ব্যবহৃত হচ্ছেন।
আলোচিত মাদক ব্যবসায়ী রাসেল ওরফে মেম্বর রাসেলের বিরুদ্ধে ১২টির বেশি মাদক মামলা আছে। পাশাপাশি অস্ত্র মামলার আসামিও তিনি। ২০২৩ সালের শেষ দিকে কাউনিয়া থানা পুলিশ তার বাসাটিতে অভিযান চালিয়ে মাদক বিক্রির নগদ অর্থ, বিপুলসংখ্যক ইয়াবা এবং ধারালো বেশ কয়েকটি অস্ত্র উদ্ধার করে। এর কিছুদিন আগে একই বছরের ১ জুন রাসেলের সহযোগী শাওনকে তালতলী ব্রিজ এলাকা থেকে ২০০ ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। এবং সে স্বীকার করে এই ইয়াবা রাসেলের, সে শুধু বিক্রিতে সহযোগিতা করছে। পুলিশ ওই মামলায় শাওনের পাশাপাশি রাসেলকে অভিযুক্ত করে এবং গ্রেপ্তারে উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ধুরন্ধর রাসেল আগাম এই খবর কোন এক মাধ্যম জানতে পেরে আত্মগোপনে নিরাপদ স্থান বেঁচে নেয়। ফলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে না পারলেও তোকে তোকে ছিল, কখন বাগে পাওয়া যায়। তবে মাঝে মধ্যে তার বাসায় পুলিশ হানা দিতো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গুচ্ছগ্রাম এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, ১০ বছরের বেশি সময় ধরে সবাইকে ম্যানেজ করে সহযোগীদের দিয়ে ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে আসছে রাসেল মেম্বার। তার সহযোগী হয়ে কাজ করছেন চরবাড়িয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা শাওন ব্যাপারী, আলামিন মোল্লা, বাবু ওরফে ল্যাপটপ বাবু, রুবেল সরদার এবং ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সালাম চৌকিদার, মামুন ফকির, সাইমুদ্দিন, হারেজ গাজী, আইয়ুব আলী ও সাইফুল সরদারসহ অর্ধশতাধিক যুবক। এছাড়া ব্যবসা পরিচালনার জন্য মেম্বারের রয়েছে দুটি ট্রলার ও একটি পিকআপ। সহযোগীদের কেউ গ্রেপ্তার হলে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান রাসেল মেম্বার, পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে গোপনে এলাকায় ফেরেন। তার অনুপস্থিতিতে ব্যবসা পরিচালনা করেন স্ত্রী শিরিন বেগম। তাদের কাছে কক্সবাজার থেকে ইয়াবার চালান আসে।
পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, স্থানীয় শতাধিক কিশোর-যুবকের সহযোগিতায় রাসেল চরবাড়িয়া ইউনিয়নের গাজীর খেয়াঘাট গুচ্ছগ্রাম এলাকাকে ‘ইয়াবার হাট’ বানিয়ে ফেলেছিল। একজন জনপ্রতিনিধির এমন অনৈতিক বাণিজ্যে স্থানীয় সচেতনমহল সংক্ষুব্ধ থাকলে রাসেলের প্রভাবের কারণে কেউ এতদিন মুখ খোলেনি। আবার কেউ কেউ প্রতিবাদ করার সাহস দেখালেও রাসেলের হুমকি-ধামকি এবং ইজ্জত হারানোর ভয়ে সামনে অগ্রসর হয়নি। ফলে রাসেল সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে পুরো চরবাড়িয়াতে মাদকের ডিলার খুলে বসে এবং এর বিষ কিশোর-যুবকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, কাউনিয়া থানাধীন এলাকায় রাসের তার বাড়ির চারদিকে সিসি ক্যামেরা দিয়ে নজরদারি করছেন, বিশেষ এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য প্রবেশ করল কী না তা দেখতেই তার এই কৌশল। রাসেলের সাথে বাণিজ্য করেছেন এমন একজন মাদক বিক্রেতা জানিয়েছেন, চতুর রাসেল শুধু তার বাসার চারপাশে নয়, অন্তত ১ কিলোমিটার দুরেও লামছড়ি সড়কের কয়েকটি স্থানসমূহে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছেন, যাতে করে তিনি সকলকে নজরদারিতে রেখে নিজে সুরক্ষিত থাকতে পারেন।
ওই বিক্রেতা জানান, এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রবেশ করছে, সিসি ক্যামেরায় বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে তিনি বাড়ির পাশে নদীতে থাকা ট্রলার নিয়ে অন্যত্র পালিয়ে যান। এই চতুরতার কারণে তাকে বারবার ব্যর্থ হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে তিনি যে কবার ব্যর্থ হয়েছেন, ততবারই গ্রেপ্তার হয়েছেন, উদ্ধার হয়েছে মাদক।
সূত্রগুলো জানায়, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতন হলে রাসেল ঘোষণা দিয়ে মাদক বিক্রি শুরু করেন, যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। ঝক্কি ঝামেলা এড়াতে তিনি দিনের বদলে গভীর রাতে মাদক বিক্রি করছেন। শহরের কেডিসি, পলাশপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা অটোরিকশা বা মোটরসাইকেলযোগে গিয়ে তার কাছ থেকে মাদক বিশেষ করে ইয়াবা সংগ্রহ করছেন।
অভিযোগসমূহ সম্পর্কে জানতে একাধিকবার রাসেলকে ফোন করা এবং হোটসঅ্যাপে ম্যাসেজ দেওয়াসহ কল করা হলেও তিনি রিসিভ না করলেও শাওন নামের এক বিক্রেতা নিশ্চিত করেন, নিরাপত্তার স্বার্থে রাসেল নিজের মোবাইল ফোন অটোরিসিভ করা ও ভয়েস রেকর্ড অপশন চালু রেখেছেন। তবে মাদক ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে তিনি হোটসঅ্যাপসহ একাধিক স্যোশাল মিডিয়া ব্যবহার করেন, যা খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও আঁচ করতে পেরেছে।
অভিযোগ আছে, কদিন পূর্বে রাসেল অন্তত তিনটি মাদকের চালান নৌরুটে নিয়ে আসেন, যাতে ৫ লক্ষাধিক ইয়াবার বড়ি ছিল। এই মাদকের একটি অংশ বিক্রি করে দিলেও বাকিগুলো তার হেফাজতে রয়েছে।
স্থানীয় সুশীল মহল সমাজ ধ্বংসের কারিগর রাসেলকে দ্রুত গ্রেপ্তার করাসহ তার হেফাজতে থাকা চার লক্ষাধিক ইয়াবা উদ্ধারের জোর দাবি জানিয়েছেন। এক্ষেত্রে গোয়েন্দা পুলিশ, র্যাব এবং সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করা হচ্ছে।’