সম্প্রতি ৩ ঘটনায় সমালোচনার মুখে বিএমপি পুলিশ

দেশ জনপদ ডেস্ক | ১৯:২১, জানুয়ারি ০৯ ২০২২ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক॥ গ্রেফতার আসামি পালানো, পুলিশের হ্যান্ডকাপ-ওয়্যারলেসসহ আসামি ছিনতাই এবং মাদকবিরোধী অভিযানে হামলার ঘটনায় সমালোচনার মুখে পড়েছে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ (বিএমপি)। বছর শুরুর প্রথম পাঁচ দিনে ধারাবাহিকভাবে তিনটি ঘটনা ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ বলা হলেও পুলিশের দায়িত্ব পালন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। সেই সাথে অপরাধীরা সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে কি না কিংবা অভিযানিক দলের দুর্বলতা কি ছিল তা খতিয়ে দেখার দাবি তুলেছেন বিশিষ্টজনরা। তিনটির পরে এভাবে আরো ঘটনা ঘটলে মেট্রোপলিটন পুুলিশ ইমেজ সংকটে পরবে বলে মনে করেন তারা। যদিও মেট্রোপলিটন পুলিশ থেকে জানানো হয়েছে, একটি ঘটনায় দায়িত্ব অবহেলার কারণে দুই পুলিশ সদস্য শাস্তির মুখে পড়েছেন। বাকি দুটি ঘটনাও গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে। বরং এসব ঘটনা থেকে প্রমাণ হচ্ছে, পুলিশ অপরাধের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। বছরের শুরুর দিন শনিবার (১ জানুয়ারি) বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে পালায় গ্রেফতার চিকিৎসাধীন আসামি মাসুদ খান। সে হ্যান্ডকাপটি খুলে বাড়ির পুকুরে ফেলে দেয়। পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাকে বৃহস্পতিবার (৬ জানুয়ারি) নগরীর আমতলা মোড় এলাকার একটি বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময়ে পুকুরের পানি সেচে হ্যান্ডকাপ উদ্ধার করে পুলিশ বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালি থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) লোকমান হোসেন। হাসপাতাল থেকে আসামি পালানোর ঘটনায় দায়িত্ব অবহেলায় হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা নায়েক মশিউর রহমান ও কনস্টেবল সজল ঘরামীকে ক্লোজড করা হয়। আর হ্যান্ডকাপসহ পালানোয় অভিযুক্ত মাসুদ খানের বিরুদ্ধে এসআই নিজাম মাহমুদ ফকির বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন। এই ঘটনার দুই দিনের ব্যবধানে সোমবার (৩ জানুয়ারি) ডিসিঘাট এলাকায় অভিযান চালিয়ে এজাহারভুক্ত আসামি শহিদুল ইসলাম কাজীকে গ্রেফতার করেন কোতোয়ালি থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক জয়ন্ত দাস। কিন্তু ডিসিঘাট এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা অভিযানিক দলের ওপর হামলা চালিয়ে অভিযানিক দলের একটি ওয়্যারলেস, আসামির হাতে পরানো হ্যান্ডকাপসহ গ্রেফতারকৃত শহিদুল ইসলাম কাজীকে ছিনতাই করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় ২৫ জনের নাম উল্লেখসহ মোট ৫৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন এসআই জয়ন্ত। গ্রেফতার করা হয় ৭ জনকে। গ্রেফতারকৃত ৭ জনের বাইরেও বাকি যারা হামলাকারী ছিলেন তাদের এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। একই সাথে পুলিশের ওপর হামলা ও আসামি ছিনতাইয়ে গ্রেফতারকৃতরা ওই এলাকায় পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতো। স্থানীয়রা বলছে, পুলিশের ওপর যারা হামলা চালিয়ে আসামি ছিনতাই করেছে তাদের নেতৃত্বে ডিসিঘাট এলাকা, অবৈধভাবে স্পিডবোট চলাচল নিয়ন্ত্রণ হয়। এমনকি মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন টিএসআইসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নিতেন। সেই সাহসেই পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা চালিয়ে আসামি ছিনতাই করতে পেরেছে। সর্বশেষ বুধবার (৫ জানুয়ারি) রূপাতলী এলাকার মান্নান খান সড়কে দুইজন ইয়াবা ব্যবসায়ী আটক করে নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) খায়রুল আলম। এ সময়ে অভিযানিক দলের ওপর মাদক ব্যবসায়ীদের সহযোগীরা হামলা চালায় বলে জানিয়েছেন, মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ফারুক হোসেন। তিনি জানিয়েছেন, এ ঘটনায় দুটি মামলায় ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যদিও দুটি ঘটনায় গ্রেফতারকৃতদের তথ্য কিংবা ছবি গণমাধ্যমে সরবারহ করেনি মেট্রোপলিটন পুলিশ। মিডিয়া সেলেও যোগাযোগ করে কোনো সহায়তা পাওয়া যায়নি। বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি সাইফুর রহমান মিরন বলেন, গ্রেফতার আসামি পলানো কিংবা আসামি ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা যখন ঘটে তখন পুলিশের অভিনবত্ব নিয়ে যে বাহবা দেওয়া হয় তা নিয়ে আমাদের মনে প্রশ্ন দেখা দেয়। গ্রেফতার আসামিরা পালিয়ে যাচ্ছেন, এমন ঘটনার পরে মনে হতেই পারে যারা পালাচ্ছেন তাদের সাথে পুলিশের কোনো লিয়াজোঁ আছে। তিনি বলেন, বছরে একটি ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু যখন ধারাবাহিকভাবে ঘটতে থাকলে প্রশ্ন দেখা দেয়। আমরা মনে করি এসব ঘটনায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরদারি দরকার। সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বরিশাল জেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, এই তিনটি ঘটনাই কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং সাধারণ মানুষের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এরআগে বরিশালের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ বাহিনী অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে কাজ করেছে। ভবিষ্যতে যেন এমন কোনো ঘটনা না ঘটে সেজন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের কঠোর নির্দেশনা প্রদান করবেন বলে আহ্বান জানান তিনি। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের জনসম্পৃক্ত কর্মকাণ্ড নিয়ে গবেষণা করা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. তারিক মাহমুদ আবির বলেন, একটি রাষ্ট্রের পরিস্থিতি রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। দেশে নির্বাচনের সময় এলে বা ক্ষমতা পালাবদলের সময় আসে তখন বিপরীত পক্ষ পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করতে চান। আমার কাছে মনে হয় জাতীয় ইস্যুই পুলিশিংয়ের ওপর প্রভাব ফেলছে। সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন বরিশাল জেলা কমিটির সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, বরিশাল নগরীর নিরাপত্তা বেষ্টনী কিছুটা সংকটে রয়েছে। ইতোমধ্যে ছোটখাটো অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সিসি ক্যামেরা বসানো বিষয়ে এক ধরনের টালবাহানা চলছে। অপরাধ দমনের জন্য মেট্রোপলিটন পুলিশ স্থানীয় কিছু লোককে সম্পৃক্ত করে কমিউনিটি পুলিশং চালানো হচ্ছে। কমিউনিটি পুলিশিংয়ে যেসব নাগরিক যুক্ত করা হয়েছে তাদের অধিকাংশ অতীতে এবং বর্তমানে নানান অপকর্মের সাথে যুক্ত। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান বলেন, পুলিশ সদস্যরা যারা অভিযান চালান তাদের হয়তো কৌশলগত ভুল থাকে। যে কারণে ‘স্মুথলি’ আসামি গ্রেফতার করা সম্ভব হয় না। পুলিশের চাকরিতে এই ধরনের ঝুঁকিগুলো থাকেই। মাঝেমধ্যে এমন দু-একটি ঘটনা ঘটে। আমরা সেগুলো দেখি আমাদের সদস্যদের কোনো গাফিলতি ছিল কি না। গাফিলতি থাকলে সেগুলো চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেই। তিনি বলেন, যেকোনো আসামি ধরতে গিয়ে যদি যথাযথ কৌশল নিরুপণ করা না হয় তহলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। আবার এমন আছে আসামি ধরতে তাড়া থাকে। হয়তো তখন ব্যাকআপ টিম আসার আগেই আসামি ধরতে যায়। তখন এমন ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনার সাথে অপরাধীরা সংঘবদ্ধ হচ্ছে এমন কোনো যোগসূত্র নেই। বরং পুলিশ যে অপরাধীদের বিরুদ্ধে তৎপর রয়েছে সেটাই প্রমাণ করে।