তদন্তের মুখে বদলি চাইলেন মীর্জাগঞ্জের ওসি মহিবুল্লাহ

দেশ জনপদ ডেস্ক | ১৮:০৩, অক্টোবর ০২ ২০২১ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ পটুয়াখালীর মীর্জাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মহিবুল্লাহ কর্মস্থলের বদলি চেয়ে আবেদন করেছেন। গাছ থেকে পড়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ আটকে রেখে ঘুস দাবির অভিযোগে মুহিবুল্লাহর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। যদিও এ অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন। বদলির আবেদনের বিষয়টি স্বীকার করলেও তদন্তের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই বলে তিনি দাবি করেছেন। এদিকে সাবেক ছাত্রদল নেতা মহিবুল্লাহর বিরুদ্ধে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নৌ-বহরে হামলার অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগেরও বর্তমানে তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র। অভিযোগকারীরা বলছেন, তদন্তের গতি শ্লথ করতে আর নিজেকে বাঁচাতে বদলির আবেদন করেছেন মহিবুল্লাহ। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলছে, তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই তার (মহিবুল্লাহ) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বরগুনার বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ এলাকায় আমড়া পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আবুল বাশার গুরুতর আহত হন। ১১ সেপ্টেম্বর বিকালে এ ঘটনা ঘটে। এরপর তাকে পটুয়াখালী জেলার মীর্জাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিলে স্বজনদের বাধা দেয় বেতাগী থানা পুলিশ। মৃত্যুকে রহস্যজনক দাবি করে মামলা এবং ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দেওয়া যাবে না জানানো হয়। এ ব্যাপারে স্বজনরা থানায় গেলে মহিবুল্লাহ লাশ দেওয়ার বিনিময়ে ২০ হাজার টাকা দাবি করেন। বাশারের ভাই মো. শাহাদাৎ জানান, দুর্ঘটনায় মৃত্যু বলে বেতাগী থানার ওসি ফোন করে মহিবুল্লাহকে নিশ্চিত করার পরও টাকা ছাড়া লাশ দেওয়া যাবে না বলে জানানো হয়। এ নিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গেটে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। স্বজনরা লাশ নিতে চাইলে মহিবুল্লাহর নির্দেশে এসআই সাইফুলের নেতৃত্বে পুলিশ বাধা দেয়। লাশ নিতে আসা লোকজনকে মারধর করা হয়। এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়- স্ত্রীসহ স্বজনদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করছে পুলিশ। তাদের গায়ে হাত তোলায় স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বাশারের স্ত্রী নাজমা বেগম বলেন, পুলিশ আমার কাপড় ছিঁড়ে ফেলে এবং ডান চোখ রক্তাক্ত করে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে রাত ২টার দিকে লাশ ছেড়ে দেয় পুলিশ। আটক তিনজনকেও ছেড়ে দেওয়া হয়। বেতাগী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মীর্জাগঞ্জ থানা থেকে জানতে চাইলে ঘটনাস্থলে লোক পাঠিয়ে জানতে পারি গাছ থেকে পড়েই বাশারের মৃত্যু হয়েছে। মীর্জাগঞ্জ থানাকে বিষয়টি জানানো হলেও কেন লাশ দেওয়া হয়নি সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। লাশ আটকে রেখে ঘুস দাবির ঘটনায় তোলপাড় শুরু হলে তদন্তে নামে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। এরপর বেরিয়ে আসতে থাকে মহিবুল্লাহর নানা অপকর্মের কাহিনি। ২০০১ সালে বরগুনার তালতলিতে জনসভা করতে যাওয়া তৎকালিন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার নৌবহরে হামলা ঘটনা ঘটে। এ হামলায় নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তৎকালীন ছাত্রদল নেতা মহিবুল্লাহর বিরুদ্ধে। ২০০৬ সালে মহিবুল্লাহ পুলিশে যোগ দেন। তালতলির একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, এলাকায় ছাত্রদলের সক্রিয় নেতা ছিলেন মহিবুল্লাহ। তালতলিতে জনসভা শেষে শেখ হাসিনা স্পিডবোটে যাওয়ার সময় বগী বাজার এলাকায় তার নৌ-বহরে হামলা করা হয়। এতে মহিবুল্লাহ সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তালতলি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি জাকির হোসেন চুন্নু বলেন, এ হামলার ঘটনায় আমরা হরতাল করেছি, বিক্ষোভ করেছি। শারিকখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আবুল বাশার বাদশা বলেন, নেত্রীর নৌ-বহরে হামলার একজন প্রত্যক্ষদর্শী আমি। সেসময় আমিও আহত হয়েছি। মহিবুল্লাহ ছিলেন হামলার অগ্রভাগে। এছাড়া ছাত্রদল নেতা হিসাবে তখন এলাকায় তিনি অত্যাচার-নির্যাতনও চালিয়েছেন। এখন ওসি হয়ে আবারও ক্ষমতা দেখাচ্ছেন। তালতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান রেজভিউল কবির বলেন, ২০০১ সালের ওই ঘটনার সময় আমি ছিলাম থানা ছাত্রলীগের সভাপতি। ওই সময় মহিবুল্লাহ ছাত্রদল নেতা ছিলেন। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি সম্পর্কে আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, উচ্চ পর্যায় থেকে তদন্ত শুরু হওয়ার পর নিজেকে ছাত্রলীগ কর্মী প্রমাণ করতে আমতলি উপজেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি মোয়াজ্জেম খানের কাছ থেকে একটি সার্টিফিকেট নিয়েছেন মহিবুল্লাহ। যেখানে লেখা রয়েছে ‘ঘটনার সময় তিনি আমতলি উপজেলা ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন।’ তবে হত্যা চেষ্টার মামলায় জেলে থাকায় মোয়াজ্জেম খানের সঙ্গে কথা বলা যায়নি। তৎকালীন উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম বাদল বলেন, মহিবুল্লাহ কখনই ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন না। তাকে ছাত্রদল নেতা হিসাবেই আমরা চিনি। এছাড়া নেত্রীর নৌ-বহরে হামলার সঙ্গেও তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ২০০১ সাল থেকে আমরা তার সম্পর্কে অবগত। এদিকে লাশ আটকে রেখে ঘুস দাবির ঘটনায় দুই দফা তদন্ত হয়েছে। ঘটনার দুইদিন পর ১৩ সেপ্টেম্বর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শামিম কুদ্দুস ভূঁইয়া এবং ১৬ সেপ্টেম্বর বরগুনার পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর মল্লিক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি ভিডিও ও লিখিত বক্তব্য নিয়েছেন তারা। যদিও তদন্ত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো কিছু বলতে রাজি হননি দুই কর্মকর্তারা। ওসি মহিবুল্লাহ বলেন, বাড়ির কাছের থানা হওয়ায় মীর্জাগঞ্জে কাজ করতে গিয়ে তাকে নানা জটিলতার মুখে পড়তে হচ্ছে। অন্যায় আবদার রাখতে না পারলে আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। তাই বদলির আবেদন করেছি। এর সঙ্গে তদন্তের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। সাবেক ছাত্রদল নেতা অথবা লাশ আটকে ঘুস দাবি করার কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, এলাকায় কিছু মানুষের সঙ্গে আমাদের বিরোধ রয়েছে। তারা এসব অপপ্রচার করছে। পুলিশ কর্মকর্তা হিসাবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র। তবে শত্রুতাবশত তার বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়েছে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তি মাথা পেতে নেব। বরিশাল রেঞ্জ পুলিশের ডিআইজি আকতারুজ্জামান বলেন, তদন্ত শেষে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে। প্রথম দফা তদন্তে কিছু অস্পষ্টতা থাকায় আবার তদন্ত করা হচ্ছে। নৌবহরে হামলার বিষয়ে চলা তদন্ত সম্পর্কে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমি অবগত নই।