৩৪০ বছর ধরে একটি গোষ্ঠীই দেখভাল করছে মসজিদটির!

দেশ জনপদ ডেস্ক | ১৬:৩৭, এপ্রিল ১৬ ২০২১ মিনিট

রিপোর্ট দেশ জনপদ॥ বিশ্বে গর্ব করার মতো বাংলাদেশের আছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ স্থাপত্যকলা। শিল্পের এই মাধ্যমে কোনও অংশে কম ছিল না এ অঞ্চল। বাংলাদেশের যে স্থাপনাশৈলী এখনও বিমোহিত করে চলেছে অগণিত ভ্রমণচারী ও মননশীল মানুষকে, তার মধ্যে আছে দেশজুড়ে থাকা অগণিত নয়নাভিরাম মসজিদ।  খাজা শাহবাজ রহ. মসজিদ ও মাজার কমপ্লেক্স নিয়ে প্রতিবেদন। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দক্ষিণ প্রান্ত ছুঁয়ে বাংলা একাডেমি ও হাইকোর্টের মাঝামাঝি এলাকায় হালকা লাল রঙা তিনটি গম্বুজ নিয়ে ৩৪২ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে হযরত হাজী খাজা শাহবাজ রহ. মসজিদ ও মাজার কমপ্লেক্স। শাহবাজ খান মসজিদ নামেও সুপরিচিত। ১৬৭৯ সালে মসজিদটি নির্মাণ করেন ঢাকার ধনাঢ্য বণিক ও সুফি শাহজাদা খাজা শাহবাজ। জনশ্রুতি আছে, তিনি নাকি টঙ্গি থেকে এখানে এসে জিনদের সঙ্গে নামাজ আদায় করতেন। প্রায় সাড়ে তিন শ’ বছর আগেকার এই মসজিদের সামনে সামিয়ানা টাঙানো খোলা চত্বরটি এখন শ্রমজীবীদের বিশ্রামের জায়গা। মসজিদটিকে কেন্দ্র করে ফুল ব্যবসায়ীদের বসতিও গড়ে উঠেছে আশেপাশে। তবে, মসজিদের ভেতরের চিত্র অনেকটাই জীর্ণ। দেয়াল থেকে সুরকি ছুটে পড়ে মাঝে মাঝে। বাইরের জমেছে শ্যাওলা। বৃহস্পতিবার (১৫ এপ্রিল) দুপুরে শাহবাজ খান মসজিদ নিয়ে কথা হয় খাদেম ও মুয়াজ্জিন মো. রাশেদ হোসেনের সঙ্গে। জানান, বংশগতভাবে তার পরিবার এই মসজিদ ও মাজার কমপ্লেক্সের দায়িত্বে আছে। মূল তদারকি করছে সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর। রাশেদ হোসেন বললেন, ‘দেয়ালের রঙ নষ্ট হয়ে গেছে। ফাটল ধরেছে বিভিন্ন জায়গায়। ভেতরের চুন, সুরকি ক্ষয়ে যাচ্ছে। আমরা মাঝে মাঝে চিঠি দিয়ে আসি প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরে। একজন লোকও আছে দেখভালের জন্য। তবে মসজিদটির আবার সংস্কার দরকার।’ আশেপাশে ফুলের দোকানিদের বাইরে অন্য কোনও বসতি না থাকায় মসজিদটিতে মুসল্লি সমাগম খানিকটা কম। করোনার কারণে কমেছে আরও। রাশেদ হোসেনের মতে, সাধারণ দিনেই এ মসজিদে মুসুল্লি কম হয়। করোনাকালে আরও কমেছে। তবে জুমার সময় সমাগম ভালো হয়। রাশেদ হোসেন শাহবাজ মসজিদ ও মাজার কমপ্লেক্সের খাদেমের দায়িত্বে আছেন ৪০ বছর ধরে। এর আগে তার বাবা মো. লাল মিয়া দায়িত্বে ছিলেন ৭০ বছর। বংশপরিক্রমায় শেখ শরিয়ত গোষ্ঠীর হাতেই মসজিদটি যাবতীয় তদারকির কাজ। রাশেদ হোসেন জানান, তার বাবার আগে দাদা আবদুল হাকিম ফকির, তার বাবা গোলাম নবী ফকির, তার বাবা আবদুল আলী ফকির খাদেমের দায়িত্বে ছিলেন। শেষজন ১১০ বছর খাদেমের দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলেও জনশ্রুতি আছে। ‘১২টি সিঁড়ি ছিল মসজিদে ওঠার। এর সামনেই তিন নেতার মাজার। মাজারটি তৈরির সময় আশেপাশের মাটি পড়ে সিঁড়িগুলো ঢেকে যায়।’ জানালেন রাশেদ। শাহবাজ খান জীবিত ছিলেন যখন, তখন থেকেই শেখ শরিয়ত গোষ্ঠী খাদেমের দায়িত্ব পালন করছে। মসজিদের পাশেই শাহবাজ খানের মাজার। আর এই মাজার-মসজিদের পূর্বদিকের ভবনে খাদেম গোষ্ঠীর বাস। এই গোষ্ঠীর অধিকাংশ লোকই এখন শাহবাগ এলাকায় ফুলের ব্যবসা করছে বলে জানান রাশেদ হোসেন। মসজিদে আয়ের প্রসঙ্গে তিনি জানান, প্রতি শুক্রবার মুসুল্লিদের দান থেকে যে অর্থ আসে, ওটাই মসজিদের মূল আয়। এ ছাড়া কুস্তি ফেডারেশনের সভাপদি তবিউর রহমানের নেতৃত্বে ৩১ জনের একটি কমিটি আছে। কমিটির সদস্যরাও আর্থিক সহযোগিতা করেন। তা থেকে ইমাম আবদুল কাদের আতহারীর বেতনভাতা ও তদারকির ব্যয় মেটানো হয়। প্রতিবছর রমজানে ইফতারের আয়োজন হলেও করোনার কারণে গতবছর ও এ বছর কোনও আয়োজন হবে না বলে জানান রাশেদ হোসেন। মাজার আঙিনায় ২০০ বছরের পুরনো একটি কাঁঠাল গাছও দেখালেন তিনি। গাছের ছায়াতেই শুয়ে আছেন শাহবাজ খান। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নোটিস বোর্ড থেকে জানা যায়, ষোড়শ শতাব্দির মুঘল স্থাপত্যরীতি মেনে ঢাকায় বেশ কয়েকটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। ওই ধারাতেই তৈরি হয়েছিল তিন গম্বুজ শাহবাজ খান মসজিদ। আকারে তুলনামূলক ছোট ও প্রাচীন মসজিদটিতে নামাজ পড়তে আসেন লালবাগ-চৌধুরীবাজারের বাসিন্দা আবরার ফাহিম। ঢাকার একটি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী মসজিদগুলোতে নামাজ পড়তে বরাবরই এক ধরনের ভালোলাগা কাজ করে। শাহবাজ খান মসজিদে যখন নামাজ পড়ি এই অনুভূতি বেশ ভালোমতো ছুঁয়ে যায়। মসজিদের দেয়ালে বসানো লাল ইট, তিনটি অতিকায় গম্বুজ ইতিহাসের কত উত্থান-পতনের নীরব সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।’ মসজিদটি ৬৮ ফুট লম্বা ও ২৬ ফুট চওড়া। মিম্বর ও চৌকাঠ কালো পাথরের তৈরি। চারটি আটকোনা মিনার রয়েছে। পূর্ব দিকের দেয়ালে আছে তিনটি প্রবেশপথ। দক্ষিণ ও উত্তর দেয়ালে একটি করে দরজা। দরজার চৌকাঠগুলো কালো পাথরের তৈরি।