শেবাচিমে ৩৬ কোটি টাকার কেনাকাটায় ২৫ ধরনের অনিয়ম

দেশ জনপদ ডেস্ক | ০৯:০৬, মার্চ ০৭ ২০২১ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক।। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দকৃত ৩৬ কোটি টাকার কেনাকাটায় ২৫ ধরনের অনিয়ম ধরা পরেছে। বাজারদরের চেয়ে উচ্চমূল্যে কেনা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি, গজ ও ব্যান্ডেজ। কোভিডকালে বেশি দামে কেনা হয়েছে মাস্ক ও পালস অক্সিমিটার। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত দামের চেয়ে বেশিতে কেনা হয়েছে হাইটেক মেডিকেল সরঞ্জাম। এরকম ২৫ ধরনের দুর্নীতির কথা উল্লেখ করেছেন স্বাস্থ্য নিরীক্ষা অধিদপ্তর। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য নিরীক্ষা অধিদপ্তর গত ১৬ থেকে ২৬ জানুয়ারি বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০১৯-২০ অর্থবছরের কেনাকাটা বিভিন্ন দিক পরীক্ষা করে দেখে। এ দলে সদস্য ছিলেন তিনজন। কাজ করার সময় নিরীক্ষক দল ৩৬ কোটি টাকার কেনাকাটায় ২৫ ধরনের অনিয়ম দেখতে পান। প্রত্যেকটি অনিয়ম পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে মোট বরাদ্দকৃত টাকার চেয়ে আপত্তিকৃত টাকার পরিমাণ বেশি দেখা যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৩৬ কোটি টাকা। যেখানে সরাসরি ১১ কোটি ১০ লাখ ৯৮ হাজার ২৯৫ টাকার দুর্নীতি হয়েছে। তবে নিরীক্ষক দল একেক ধরনের কেনাকাটায় যত ধরনের অনিয়ম দেখতে পেয়েছেন তার প্রত্যেকটি পৃথকভাবে উল্লেখ করেছেন। তারা জানান, ২০১৯-২০ আর্থিক সালের হিসাব নিরীক্ষায় সরকারি এই দল হাসপাতালের কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম দেখতে পান। এতে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের বরাদ্দকৃত অর্থসহ অন্যান্য খাতে কেনাকাটায় মোট ১১৮ কোটি ৯০ লাখ ৬২ হাজার ১৯৭ টাকার অনিয়ম তুলে ধরা হয়। বাজার মূল্যের চেয়ে অধিক দামে কেনা হয়েছে ক্যানুলা, ব্লাড ব্যাগসেট, প্লাস্টিক সিরিঞ্জ। এছাড়া অন্যান্য সামগ্রীও বেশি দামে কেনা হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঠিকাদারদের যোগসাজশের বিষয়টি যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ঠিকাদারের অনিয়মিতভাবে পরিশোধ করা হয়েছে বিপুল অঙ্কের বিল। বাজারে সর্বোচ্চ ৬শ টাকার কম্বল কেনা হয়েছে ২৪শ টাকায়। এমনকি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের জন্য বরাদ্দ টাকা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশিত খাতে ব্যয় না করে অন্যত্র খরচ করা হয়েছে। এভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে হাসপাতাল প্রশাসন নানা অনিয়মের মাধ্যমে ব্যয় করেছে ৩৬ কোটি টাকা। বেশি দাম, ক্রয় নীতি লংঘন এবং অসাধু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের দুর্নীতির কারণে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ১১ কোটি টাকা। এর সঙ্গে হাসপাতালের কর্মকর্তাদের একটি প্রভাবশালী অংশ এবং কয়েকজন দুর্নীতিগ্রস্ত ঠিকাদার সরাসরি জড়িত রয়েছে বলে জানা গেছে।  এদিকে, নিয়মানুযায়ী নিরীক্ষা রিপোর্টটি গ্রহণ করার কথা থাকলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা সরাসরি গ্রহণ করেনি। ফলে এ দলের সদস্যরা বরিশাল সদর পোস্ট অফিস থেকে রিপোর্টটি হাসপাতালের পরিচালকের কাছে ডাকযোগে পাঠায়। এছাড়া নিয়মানুযায়ী এর কপি স্বাস্থ্য নিরীক্ষা অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। নিরীক্ষা দলের পক্ষ থেকে নিয়মানুযায়ী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে এসব অনিয়মের জবাব দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. বাকির হোসেন বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে তার হাসপাতালে সরকারি বরাদ্দ ছিল মাত্র ৩৬ কোটি টাকা। তাই ১১৮ কোটি টাকার অনিয়ম করার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, অডিটে যে ২৫টি অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর লিখিত জবাব ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তিনি সরাসরি কেন অডিট রিপোর্টের কাগজপত্র গ্রহণ করেননি জানতে চাইলে বলেন, আমি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আপত্তি গ্রহণ করেছি এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই তার জবাব দিয়েছি। এদিকে নীরক্ষক দলের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, হাসপাতাল প্রশাসন ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে এমএসআর (মেডিকেল, সার্জিক্যাল রিকুজিট) যন্ত্রপাতি ক্রয় করেছে। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে এক কোটি ২৫ লাখ ৯৭ হাজার ৪৫০ টাকা। সরকারি ওষুধ কোম্পানি ইডসিএল (এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লি.) থেকে ওষুধ না কিনে সরবরাহকারীর কাছ থেকে ওষুধ কেনায় আর্থিক ক্ষতি এক কোটি ৪৮ লাখ ৫৫ হাজার ১০ টাকা। কল সেন্টার মেশিন কিনে ব্যবহার না করে ফেলে রাখায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৪০ লাখ টাকা। এছাড়াও বেশি দামে নিন্মমানের কম্বল ও ফোম ম্যাট্রেস কেনায় আর্থিক ক্ষতি ২৫ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। ৯৯ শতাংশ থেকে ২৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বেশি দামে মাস্ক ও পালস অক্সিমিটার কেনায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি ৩৫ লাখ ৮৬ হাজার ৮৬০ টাকা। বেশি দামে গজ-ব্যান্ডেজ কেনার মাধ্যমে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে এক কোটি ৯ লাখ ৪ হাজার ৭শ টাকা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত বেডশিট কিনে ফেলে রাখায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি ৬৫ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। ব্যবহারে উপযুক্ত স্থান ও জনবল না থাকলেও মেডিকেল সরঞ্জাম কিনে ফেলে রাখায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি ৩৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। হাসপাতালে ৭টি এক্স-রে মেশিন চলমান থাকার পরও সিএমএসডি থেকে এক্স-রে মেশিন সরবরাহ নেওয়ায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৭০ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও জুন মাসে তামাদি এড়াতে প্রয়োজন অতিরিক্ত ওষুধ কিনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরকারের আর্থিক ক্ষতি করেছে ৩ কোটি ৫৪ লাখ ৫ হাজার ২২০ টাকা। এক্স-রে ফ্লিমের হিসাব ঘাটতির কারণে সরকারের আর্থিক ক্ষতি ১২ লাখ ৭১ হাজার ৬১৫ টাকা। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত দামের চেয়ে বেশিতে হাইটেক মেডিকেল সরঞ্জাম কেনায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে এক কোটি ৭১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এসব কেনাকাটায় সরকারের প্রত্যক্ষ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে সর্বমোট ১১ কোটি ১০ লাখ ৯৮ হাজার ২৯৫ টাকা।  এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, এ ধরনের অনিয়মের দলিলপত্র এখনো তার হাতে এসে পৌঁছায়নি। তবে এ ধরনের ভয়াবহ অনিয়ম কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কাগজপত্র পেলে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।