নৌকা মাঝিমাল্লা সমিতির নামে চাঁদাবাজি

দেশ জনপদ ডেস্ক | ২৩:০০, নভেম্বর ০৪ ২০২০ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশাল নগরীর ব্যস্ততম চরকাউয়ার খেয়াঘাট। ভোর থেকে সারারাত অবধি এই ঘাটে দুই শিফটে চলাচলকারী ১০৭টি ইঞ্জিন চালিত নৌকায় হাজার হাজার যাত্রী ও শতাধিক মোটরসাইকেল পারাপার হয়। উন্নত যাত্রীসেবার মান নিশ্চিতের লক্ষ্যে ২০১০ সালে কাউয়ার চর খেয়াঘাটকে টোল ফ্রি ঘোষণা করেন বরিশাল ৫ আসনের সাবেক এমপি ও বিসিসি মেয়র শওকত হোসেন হিরন। এরপরই এই ঘাটে বাড়ানো হয় ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও ট্রলার সংখ্যা। এরপর সাবেক এমপি হিরনের মৃত্যুর পরপর “নৌকা মাঝিমাল্লা” নামে একটি সমিতি করে স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন। শুরু হয় প্রতিটি নৌকা থেকে চাঁদা আদায়। ফলে নৌকার মাঝিরাও যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া শুরু করে। প্রতিটি লোকের পারাপারের জন্য ২ টাকা নেয়ার কথা থাকলেও আদায় করা হয় ৫ টাকা এবং প্রতিটি মোটরসাইকেল থেকে ২০ টাকার পরিবর্তে আদায় করা হয় ৬০ টাকা। এছাড়া প্রতিটি বাইসাইকেল পারাপারের জন্য ৫ টাকার পরিবর্তে নেয়া হয় ১০ টাকা। এবং অন্যান্য মালামালের জন্য গুণতে হয় অতিরিক্ত টাকা। এভাবেই বছর জুড়েই চরকাউয়া খেয়াঘাটে চলতে থাকে চাঁদাবাজির এমন রগরগে চিত্র। আর এই চাঁদাবাজির মূলে রয়েছে মাঝিমাল্লা সমিতির সভাপতি মোঃ ওমর আলী গংদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। একটি সূত্র জানায়, সমিতির নামে প্রতিটি নৌকা থেকে প্রতিদিন দুই শিফটে ২০ টাকা করে উত্তোলন করা হয়। সকালের শিফটে ১০৭টি ইঞ্জিনচালিত নৌকার মধ্যে যতগুলো নৌকা চলাচল করে তাদের কাছ থেকে প্রত্যেক নৌকা বাবদ ২০ টাকা আদায় করা হয়। একইভাবে দুপুরের শিফটে ওই ১০৭টি ইঞ্জিনচালিত নৌকার মধ্যে যতগুলো নৌকা পারাপারের জন্য চলবে প্রত্যেক নৌকা থেকে ফের ২০ টাকা আদায় করা হয়। এভাবে প্রতিদিন যে পরিমান চাঁদার টাকা আদায় করা হয় তাতে দেখা গেছে প্রত্যেকটি নৌকা থেকে দুইবার করে মোট ৪০ টাকা আদায় করা হয়। এতে নৌকার সংখ্যা নিদিষ্ট থাকলেও আদায়কৃত চাঁদার টাকার পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায়। সেই হিসেবে প্রতি মাসে প্রায় ১ লক্ষ টাকা চাঁদা আদায় করা হয় সমিতির নামে। আদায়কৃত চাঁদার টাকা সমিতির ৮ সদস্যদের মধ্যে ভাগাভাগি করা হয়। এই বিষয়ে কাউয়ার চর খেয়াঘাটের মাঝি হানিফ, নান্নাসহ একাধিক মাঝি বলেন, আমরা তুফান, ঝড়-বৃষ্টি ও রৌদ্রের মধ্যে নদীতে নৌকায় জনগনকে পারাপার করে যে টাকা পাই সেই টাকার একটি অংশ সমিতির সভাপতিকে দিতে হয়। চাঁদার টাকা না দিলে পরের দিন ঘাটে নৌকা ভিড়তে দেয় না। অপর এক মাঝি রুম্মান অভিযোগ করে বলেন, সমিতির সভাপতি করোনাকালীন সময়ে আমাদের কোন মাঝিদের যাত্রী পারাপার করতে দেয়নি। শুধু তিনি নিজে যাত্রীদের পারাপার করছেন এবং প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ঘাটে অন্য মাঝিরা না থাকায় জনগন বাধ্য হয়ে বেশী টাকা দিয়ে তার নৌকায় পারাপার হয়েছেন। তাছাড়া করোনাকালীন সময়ে সমিতি থেকে আমাদের কোন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করা হয়নি। এদিকে অপর একটি সূত্র জানায়, খেয়াঘাটে নতুন কোন নৌকা পারাপারের জন্য নামতে দেয়া হয়না। তবে কোন মাঝি যদি নৌকাসহ লাইন হস্তান্তর কিংবা বিক্রি করে সেক্ষেত্রে সমিতির সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লেনদেন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। এ ধরনের একটি নৌকা লাইনসহ হস্তান্তর করতে ৩ থেকে ৪ লক্ষ টাকা আদায় করা হয়। নৌকার মালিককে কেবলমাত্র নৌকার দাম পরিশোধ করা হয় এবং বাকি টাকা লাইন বাবদ সমিতির নামে আত্মসাত করা হয়। সূত্রটি আরো জানায়, এদের রয়েছে নিজস্ব বলয়। পারাপারের জন্য সমিতির নির্ধারিত ভাড়া নিয়ে কোনো যাত্রী ট্রলার চালকদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে গেলে কিংবা ঘাটে এদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে গেলেই ঐক্যবদ্ধভাবে যাত্রীদের হেনস্তা করে তারা। এই বিষয় নৌকা মাঝিমাল্লা সমিতির সভাপতি মোঃ ওমর আলীর সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, আমি কোন টাকা নেই না বরং যেই টাকা নেয়া হয় সেই টাকা নৌকা মাঝিমাল্লার সমিতির জন্য নেয়া হয়। প্রতিদিন মাত্র ২০ টাকা করে প্রতিটি নৌকা থেকে আদায় করা হয়। এছাড়া আপনারা তো সমিতির নামে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভাই ট্রলার চালাতে তেলের খরচ এবং সমিতির লোকজনের খরচ চালাতে খুবই কষ্ট হয় তাই যাত্রীদের কাছ থেকে অল্প কিছু বেশী নেয়া হয়। এদিকে নাজমুল নামে খেয়াঘাটের এক যাত্রী দেশ জনপদকে জানায়, ২০১০ সালের আগে প্রতি যাত্রী থেকে ৫ টাকা নেয়া হত। কিন্তু সাবেক সফল মেয়র শকত হোসেন হিরন জনগনের ভোগান্তি দেখে যাতায়াতের সুবিধার্থে চর কাউয়া খেয়া ঘাট ইজারা উন্মুক্ত করে জনগনের জন্য ফ্রি করে দেয়। এরপর থেকে পারাপারের জন্য ২ টাকা করে আদায় করা হলেও তার মৃত্যুর পর মাঝিমাল্লা সমিতি করে পারাপারের জন্য ফের ৫ টাকা আদায় করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, মোটরসাইকেলের ভাড়া ২০ টাকার পরিবর্তে ৪০ থেকে ৬০ টাকা আদায় করা হয়। উল্লেখ্য, কাউয়ার চর খেয়াঘাটে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গত মঙ্গলবার দুপুরের দিকে জেলা প্রশাসনের একটি মোবাইল কোর্ট চরকাউয়া খেয়াঘাটে অভিযান পরিচালনা করেন। এসময় অভিযোগের সত্যতা পেয়ে ৬ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। পাশাপাশি নির্ধারিত ভাড়া ২ টাকার অধিক যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় না করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।