নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ কিশোর অপরাধ একটি সামাজিক ব্যাধি। ৭ থেকে ১৮ বছরের নিচে কেউ কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পরলে তাকে কিশোর অপরাধ বলা হয়ে থাকে। কিশোর অপরাধের অন্যতম কারণ দারিদ্রতাকে উল্লেখ করা হলেও বগুড়ায় এর প্রেক্ষাপট অনেকটাই ভিন্ন। বগুড়ায় সেভাবে কিশোর অপরাধীদের গ্যাং গড়ে না উঠলেও অভিভাবকদের অবহেলা-প্রশ্রয়ে দিন দিন কিশোর অপরাধ মারাত্মক আকার ধারণ করছে। মধ্যবিত্ত ও ধনী পরিবারের অনেক কিশোর নানান অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে সমাজের বোঝা হয়ে উঠেছে। পরিবারের কাছে আবদারেই স্বপ্নপূরণ হচ্ছে ওইসব কিশোরদের। আর এতেই বাড়ছে তাদের দৌরাত্ম্য। শহরে রেজিস্ট্রেশন ও লুকিং গ্লাসবিহীন উচ্চ শব্দের সাইলেন্সার ব্যবহার করা মোটরসাইকেলে চেপে চোখে সানগ্লাস, মুখে হালকা ফার্স্ট দাঁড়ি, গলায় চেইন, টি-শার্ট ও থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরা কিশোররা শহরের গার্লস স্কুল-কলেজ, কোচিং সেন্টারসংলগ্ন এলাকা এবং বিভিন্ন মোড়ে আড্ডার সঙ্গে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। অনেকে স্কুল ব্যাগে বই-খাতার সঙ্গে থাকে মাদক ও ধারালো ছুরি। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মারামারি, উত্যক্ত, খুন, চুরি, ধর্ষণ, ছিনতাই, মাদক ব্যবসাসহ নানান অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। এবারের ১ জানুয়ারি থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত গত ১০ মাসে আদালতের নির্দেশে জেলার প্রায় ৮০ জনকে যশোর জেলার পুলেরহাট শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। জানা যায়, বাংলাদেশে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে তিনটি। এর মধ্যে যশোর জেলার পুলেরহাটে একটি, গাজীপুর জেলার কোনাবাড়িতে ছেলে ও মেয়ের জন্য আলাদা দুইটি। এর মধ্যে যশোরের পুলেরহাটের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে ধারণক্ষমতা রয়েছে ১৫০ জন। সেখানে ধারণক্ষমতা ছারিয়ে অতিরিক্তসহ রয়েছে মোট ৩৫০ জন। বগুড়া সদর উপজেলার রহমান নগর এলাকার মৃত জাহেদুল ইসলামের ছেলে রশিদুল ইসলাম (৩২)। পেশায় একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি একাধিক সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। রশিদুল গত ১৩ অক্টোবর দুপুর সোয়া ২টার দিকে শহর থেকে রিকশায় বাড়ি ফিরছিলেন। পথে ভাগিনা শিশু শান্তকে (১২) স্থানীয় টাউন স্কুলমাঠে খেলাধুলা করা অবস্থায় কয়েকজন কিশোরের মারধরে দৃশ্য লক্ষ্য করেন রশিদুল। ভাগিনাকে মারধর করতে দেখে ওই কিশোরদের সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে যান রশিদুল। এসময় তার ভগ্নিপতি বছির ছেলেকে মারধরের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন। সেখানে তর্ক-বিতর্কের একপর্যায় মারধরকারী কিশোররা রশিদুলের এবং বছিরের শরীরের বিভিন্ন এলাকায় ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা তাদের দুইজনকে উদ্ধার করে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেকে) হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকেলে রশিদুলের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর বুধবার (১৪ অক্টোবর) সকালে নিহত রশিদুলের স্ত্রী কেয়া খাতুন বাদী হয়ে বগুড়া সদর থানায় দুই কিশোর সামাইল মাহাদী ভুইয়া ও সিয়ামের নামে মামলা দায়ের করেন। শুক্রবার (১৬ অক্টোবর) রাতে অভিযান চালিয়ে সিয়ামকে আটক করে পুলিশ। বগুড়ায় স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে এক নিবেদিত প্রাণ ছিলেন রশিদুল ইসলাম। কিশোর গ্যাংয়ের হাতে তার মতো পরীক্ষিত এক মানবদরদীর মৃত্যুতে জেলার স্বেচ্ছাসেবীরা রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। কারণ অন্যকে (ভাগিনা) বাঁচাতে যাওয়ার কারণেই খুনিরা তাকে টার্গেট করেছে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ব্লাড ডোনেশন ক্লাবের মুখপাত্র সজীব বলেন, সমাজের জন্য ভালো কিছু করতে গিয়ে যদি এভাবে প্রাণ দিতে হয় তাহলে ভবিষ্যতে মানুষের কল্যাণে কাজ করার মত কাউকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই তারাসহ বগুড়ার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে রশিদুলের খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি এবং কিশোরদের দৌরাত্ম্য এড়াতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। গত ২৪ আগস্ট বগুড়া সদর উপজেলায় চুরির উদ্দেশে শামসুন নাহার (৭০) নামে এক বৃদ্ধাকে হত্যার পর নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও মোবাইল নিয়ে পালানোর সময় তাইরান নেওয়াজ (১৭) নামে এক কিশোরকে আটক করা হয়। পুলিশ জানায়, কিশোর তাইরান নেওয়াজ প্রতিবেশী হওয়ায় ওই বৃদ্ধার বাড়িতে সহজেই প্রবেশ করে। পরে ওই বৃদ্ধাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। এরপর আলমারিতে থাকা তিন হাজার টাকা, বৃদ্ধার কানের দুল, দুইটি মোবাইল ফোন নিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে তাকে আটক করা হয়। গত ৬ জুন বগুড়ার ধুনট উপজেলায় টেলিভিশন দেখার কথা বলে ঘরে ঢুকে এক শিশুকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে উপজেলার চৌকিবাড়ি ইউনিয়নের রুদ্রবাড়িয়া-কাষ্টসাগর গ্রামের মজিদ শেখের কিশোর ছেলে নয়ন শেখ (১৬)। কিশোর নয়ন ছাড়াও এ ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তার বড় ভাই ফজর শেখ। পরে এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করা হয়। বগুড়া সারিয়াকান্দি উপজেলার পূর্ব টেংরাকুড়া গ্রামের ১৫-১৬ বছর বয়সী তিন বন্ধু আবদুর রহিম, আলী মিয়া ও রাসেল মিয়ার নজর পড়ে প্রতিবেশী এক কিশোরীর ওপর। প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হয়। গত বছরের ১২ জুন দুপুর ২টার দিকে ওই কিশোরী গ্রামের দোকান থেকে খাবার কিনে বাড়ি ফিরছিল। পথে তিন কিশোর তার মুখ চেপে পাটক্ষেতে নিয়ে যায়। আবদুর রহিম ধর্ষণ করে ও অন্য দুইজন সহযোগিতা করে। লোকজন চলে আসায় তারা পালিয়ে যায়। পরে মেয়েটির মা থানায় মামলা করলে পুলিশ তাদেরকে আটক করে। পরে আদালতের নির্দেশে তাদের যশোরের পুলেরহাটে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। শহরের জলেশ্বরীতলা এলাকার হাসানুল মাশরেক রুমনের মাইসা ফাহমিদা সেমন্তি (১৫) মেয়ে। ফেসবুকে আপত্তিকর ছবি ছড়ানোয় গত বছরের ১৭ জুন মাইসা ফাহমিদা সেমন্তি আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার আগে সুইসাইড নোটে একজন বন্ধুর কথাও উল্লেখ করেছে মাইসা। বগুড়া শহরের ওয়াইএমসিএ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী ছিল সে। তার মৃত্যু পরদিন সকালে তার মরদেহ উদ্ধারের পর পরিবারের লোকজন তার লিখে যাওয়া সুইসাইড নোটটি পায়। সুইসাইড নোটে মাইসা আত্মহত্যার বিস্তারিত কারণ উল্লেখ না করলেও আবির নামে এক বন্ধুর নাম লেখেন। সুইসাইড নোট উদ্ধারের পর পরিবারের সদস্যরা মাইসার মোবাইলফোনের কললিস্ট ও ফেসবুকে মেসেঞ্জারে তথ্য আদান-প্রদান ছাড়াও সহপাঠী ও বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে তারা জানতে পারেন, আবির (১৭) নামে এক ছেলের সঙ্গে মাইসার সর্ম্পক ছিল। আবির বিভিন্ন সময় মাইসার মোবাইলফোনে কথাও বলেছে। মাইসা ফাহমিদা নামে একটি ফেসবুক আইডি থেকে মেসেঞ্জারে আবিরকে একান্ত কিছু ছবি আদান-প্রদান করে সে। সেই ছবি ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে শাহরিয়ার অন্তর (১৬) নামে আরও একজন জড়িত। এ ঘটনায় অপমান সইতে না পেরে লজ্জা ও ক্ষোভে আত্মহত্যা করে মেয়েটি। বগুড়ায় কিশোর অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের সু-নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা নেই। তবে শহরে ছোট-বড় সবমিলিয়ে কিশোর গ্যাং রয়েছে প্রায় ৮ থেকে ১০টির মতো। মানুষকে মারধর থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে ভয়ংকর হয়ে উঠছে এ কিশোর গ্যাংগুলো। অনেকে জড়িয়ে পড়ছে মাদক সেবনে। সিগারেট থেকে শুরু হচ্ছে তাদের নেশার জন্ম। আস্তে আস্তে আশক্ত হচ্ছে অন্যান্য নেশায়। সেসঙ্গে মাদক সেবন থেকে জড়িয়ে পড়ছে বিক্রিতে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের সঙ্গে মিশে একত্র হচ্ছে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত অছাত্র কিশোররা। তাদেরকে দলে এনে তৈরি করছে এক একটি গ্রুপ। আধিপত্য নিয়ে চলছে নানান অপরাধ কর্মকাণ্ড। এ বিষয়ে বগুড়া লেখক চক্রের সভাপতি ইসলাম রফিক বলেন, সামাজিকভাবে প্রতিরোধ এবং আইনের আওতায় আনা না গেলে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা দিন দিন বাড়বে। এক্ষেত্রে অভিভাবকরা যদি সচেতন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা যদি দায়িত্বশীল এবং স্কুল-কলেজে নজরদারি বাড়ানো হয় তাহলে অনেকাংশে কমে আসবে কিশোর অপরাধীদের সংখ্যা। ওই লেখক বলেন, অভিভাবককে তাদের সন্তানদের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। সন্তানদের পাঠ্যবই ব্যতীত বিভিন্ন বই (কবিতা, সাহিত্য, গল্প) এবং দৈনিক পত্রিকা নিয়মিত পাঠের অভ্যাস করতে হবে। কেননা এটি শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশে সাহায্য করে থাকে। বগুড়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট নরেশ মুখার্জি বলেন, অভিভাবকদের অসচেতনতা-অবহেলা ও প্রশ্রয়ের কারণে কিশোর অপরাধ বাড়ছে। তাদের কারাগারে আটকে রেখে বিচার করা যায় না, জামিনের বিধান আছে। পুলিশের বিশেষ কিছু করার থাকে না। সন্তানদের প্রতি অভিভাবকদের খেয়াল নেই। শিশু-কিশোর অপরাধ কমাতে বাবা-মা ও অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। বগুড়া জেলা প্রবেশন কর্মকর্তা আবু সালেহ মো. নূহ্ বলেন, জেলায় কিশোর অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের সংখ্যার নির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই। তবে বগুড়া জেলায় এখন কিশোর অপরাধের সঙ্গে জড়িত মোট ৩০ জন শিশু-কিশোর যশোর জেলার পুলেরহাট শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে রয়েছে। বাকিরা জামিনে রয়েছে। তারা বিভিন্ন অপরাধ যেমন, মারামারি, হত্যা, চুরি, ছিনতাইসহ একাধিক অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এছাড়া শিশু অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে জেলায় জামিনে থাকা ২৬ জন শিশু-কিশোর আমার আওতাধীন রয়েছে। তাদের দেখভাল করছি আমি নিজেই। তিনি বলেন, সারাদেশে শিশু-কিশোর সংঘটিক অপরাধের বিস্তৃতি ঘটার পেছনে দারিদ্র, অশিক্ষাসহ বিভিন্ন আর্থসামাজিক, পারিবারিক ও মনস্তাত্বিক ডাইমেশন রয়েছে। শিশু অপরাধের বিস্তৃতি রোধকল্পে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও ব্যাপক সামাজিক গণসচেতনতা বাড়াতে হবে। এছাড়া এখন শিশু অপরাধীদের হেফাজতের জন্য বাংলাদেশে মাত্র তিনটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে, এর পরিমাণ এবং জনবল বাড়াতে হবে। বগুড়া জেলা প্রবেশন কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি ইউনিসেফ সংস্থাটি শিশু অপরাধের সঙ্গে জড়িত সাজাপ্রাপ্ত দরিদ্র পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতার একটি কাজ হাতে নিয়েছেন। এ তালিকায় বগুড়ার মোট ১২ জনের নামোল্লেখ রয়েছে। তাদের পরিবারকে ছয় মাস পর্যন্ত প্রতিমাসে সাড়ে তিন হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। এদের মধ্যে জেলার ধুনট উপজেলার একজন, গাবতলীতে একজন, কাহালু উপজেলার দুইজন, সারিয়াকান্দিতে একজন, শাজাহনপুরে তিনজন, শেরপুরে তিনজন এবং শিবগঞ্জ উপজেলার একজন। বিষয়টি একটি ব্যতীক্রম কার্যক্রম ইউনিসেফ সংস্থাটির। তবে অপরাধীদের পরিবারকে অর্থ দেওয়ার এটিতে ভিকটিম, ভুক্তভোগী বা অভিযোগকারী পরিবারের মধ্যে ভিন্ন মতামত আসতে পারে বলে যোগ করেন ওই কর্মকর্তা। বগুড়ার পুলিশ সুপার (এসপি) আলী আশরাফ ভূঞা বলেন, জেলায় সংঘবদ্ধ কিশোর গ্যাং নেই বললেই চলে। তবে, কিশোর অপরাধের সঙ্গে জড়িত রয়েছে অনেকেই। এ বিষয়ে কিছু মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। শিশু-কিশোররা নিজেদের মধ্যে মারামারির মতো অপরাধে বেশি লিপ্ত হয়ে থাকে। কিশোরদের সঙ্গে কিশোরীরাও অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। অল্প বয়সে প্রেমঘটিত কারণে তারা অপরাধের সৃষ্টি করছে। পারিবারিক সচেতনতার ফলে এ বিষয়গুলো রোধ করা সম্ভব। এছাড়াও বগুড়ায় একটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র প্রয়োজন বলে যোগ করেন তিনি।