নগরীতে মজুরি বৈষম্যের শিকার শিশু শ্রমিকরা

দেশ জনপদ ডেস্ক | ২৩:০২, অক্টোবর ০৫ ২০২০ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ ‘‘শিশুর সাথে শিশুর তরে বিশ্ব গড়ি নতুন করে” শীর্ষক প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে গতকাল থেকে সপ্তাহ ব্যাপী বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ উদযাপিত হতে যাচ্ছে। এ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বরিশাল জেলা প্রশাসন। মূলত শিশুদের জীবনের নিরাপত্তা এবং তাদের মৌলিক চাহিদাসমূহ নিশ্চিতের লক্ষ্যে শিশু দিবস পালন করা হয়। তবে এত কিছুর পরও রোধ করা যাচ্ছে না শিশুশ্রম। এরই ধারাবাহিকতায় বরিশালেও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা। যে বয়সে শিশুদের শিক্ষা গ্রহণে স্কুলে থাকার কথা, হাতে থাকার কথা কলম, সেখানে তারা হাতে তুলে নিচ্ছে ছেনি, বাটালি, করাত অথবা রেঞ্চ। অভাবের তাড়নায় তারা বিভিন্ন কারখানা, ওয়ার্কশপ, কাঠ মিস্ত্রি, রাজ মিস্ত্রি, হোটেল-রেস্তোরাঁর কাজে যুক্ত হচ্ছে। কেউ বা ঠেলছে ঠেলাগাড়ি, চালাচ্ছে রিক্সাভ্যান। অনেকে মালামাল বহনের মত ভারী কাজও বেছে নিচ্ছে। কন্যা শিশুরা করছে গৃহপরিচারিকার কাজ। নগরীর প্রায় সর্বত্রই এমন অবস্থা বিরাজমান। বয়সের তুলনায় ভারী এবং অপরিচ্ছন্ন কর্মক্ষেত্রের কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে শিশু শ্রমিকরা। আইন অনুযায়ী শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা কোনো কার্যকর পদ্ধতি প্রয়োগ না করায় শিশুদের শারীরিক এবং মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবার শংকা প্রকাশ করেছে সুধী সমাজ। এ অবস্থা রোধে জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণে প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে অভিমত তাদের। বরিশালে গতকাল সোমবার থেকে বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ উদ্বোধন হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে আয়োজিত মুক্ত আলোচনায় বরাবরই আলোচকরা শিশু শ্রমের বিভিন্ন নেতিবাচক দিক তুলে ধরেন। এছাড়া কর্মক্ষেত্রে শিশুদের সাথে মজুরি নিয়ে বৈষম্যমূলক আচরণের বিষয়টিও প্রাধান্য পায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বরিশালে শিশু শ্রমিক আছে কয়েক হাজার। আর এ সংখ্যা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অভাবী পরিবারের শিশুরা বাধ্য হয়ে শিশু শ্রমের দিকে ঝুঁকছে। নিরুপায় দরিদ্র মা-বাবাও এসব ক্ষেত্রে শিশুদের সম্পৃক্ত করতে বাধ্য হচ্ছেন। আর এ সুযোগটিকে কাজে লাগাচ্ছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এদের বিরুদ্ধে শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগের পাশাপাশি মজুরি নিয়ে বৈষম্য সৃষ্টিরও অভিযোগ রয়েছে। নগরীর একটি খাবার হোটেলের শ্রমিক জলিল জানায়, তার মালিক উদয়-অস্ত হাড় ভাঙা পরিশ্রম করিয়ে মাসান্তে মাত্র ৩ হাজার টাকা ধরিয়ে দেন। যেখানে তার সহকর্মী বয়স্ক কর্মচারীর বেতন প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি। বছরের পর বছর কাজ করলেও তাদের মজুরি বাড়ানো হয় না। মজুরি বাড়ানোর কথা বললে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়। নগরীর বাজার খোলা, বান্দরোড, পোর্ট রোড, চাঁদমারি, বিউটি হল রোড ঘুরে দেখা গেছে, লেদ মেশিন, করাতকল, ওয়ার্কশপগুলোতে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরি, মালামাল বহন, ওয়েল্ডিংসহ ভারী এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করছে শিশুরা। শিশু শ্রমিক ফরহাদ, খলিল, অজয়, মামুন জানায়, সংসারের খরচ যোগাতে এ ধরনের কাজ করছে তারা। স্কুলে যাবার কথা শুনে হেসে ওঠে অনেকেই। তাদের ভাষায়, “স্কুলে গ্যালে প্যাডের ভাত জোটাইবে কেডা!” এরা সকলেই দিন মজুর পরিবারের সন্তান। পোর্টরোডের একটি ওয়ার্কশপের শিশু শ্রমিক মামুন (১২)’র কাছে মজুরি বৈষম্যের কথা জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেয়ার আগেই তেড়ে আসেন ওয়ার্কশপ মালিক আলাউদ্দিন। এই প্রতিবেদকের সামনেই পিঠে দু/এক বসিয়ে মামুনকে সেখান থেকে সরিয়ে দেন। আলাউদ্দিনের মতে, শিশু শ্রমের বিষয়ে তিনি অবগত নন একবারেই। তবে মজুরি বৈষম্যের কথা স্বীকার করে বলেন, ওদের (শিশু শ্রমিক) কাজের গতি কম তাই মজুরিও কম। এভাবে শুধু মামুনই নয়, নগরীর প্রায় সর্বত্রই মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে শিশু শ্রমিকরা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মারধরের ঘটনাও ঘটছে। পাশাপাশি বাড়ছে নানা ধরনের কাজে শিশু শ্রমের সম্পৃক্ততা। এ বিষয়ে জেলা শ্রমিকলীগের সভাপতি শাহজাহান হাওলাদার বলেন, আইনানুযায়ী শিশু শ্রম পুরোপুরি নিষিদ্ধ। তবে অভাবের কারণে শিশুরা এসব কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছে। হচ্ছে মজুরি বৈষম্যের শিকার। এটা একবারেই কাম্য নয়। এ অবস্থা রোধে সংশ্লিষ্টদের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি। জানতে চাইলে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কাজল ঘোষ বলেন, বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার কারণে শিশু শ্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে শিশুরা যেমন স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে, তেমনি স্বাক্ষরতার হারের মাত্রাও নীচে নামছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে অভিভাবকদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। পাশাপাশি খেটে খাওয়া শিশুদের পুনর্বাসন এবং অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থাও জোরদারকরণের বিষয়ে অভিমত ব্যক্ত করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কাজল ঘোষ।