পদ্মা সেতুকে ঘিরে বরিশালে বিনিয়োগের দরজা খুলছে॥

দেশ জনপদ ডেস্ক | ২১:৩৩, সেপ্টেম্বর ২২ ২০২০ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ দেশের অর্থনীতি চাঙা হওয়ার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য, অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহন এবং মানুষের যাতায়ত দ্রুত করতে সমৃদ্ধ যোগাযোগ ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। পদ্মা সেতু দেশের অর্থনীতির জন্য সেই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্বার খুলে দিচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলা ছাড়াও পুরো দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে পদ্মা সেতু। সেতুর নির্মাণ কাজ যতই এগিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতির সম্ভাবনার দুয়ার তত খুলছে। পদ্মা সেতুকে ঘিরেই উদ্যোক্তারা দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগের ডালা খুলে বসছেন। গ্রহণ করা হচ্ছে, অসংখ্য মেগা প্রকল্প। আবাসন শিল্প, পর্যটন শিল্প, হাইটেক পার্ক, তাঁতপল্লীসহ অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে। স্বপ্নের এই সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অর্থনীতির পুনর্জাগরণ ঘটবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, পদ্মা সেতুর সঙ্গে বদলে যাবে ওই এলাকার অবকাঠামো, কৃষি, স্বাস্থ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তির ধারা। একই সঙ্গে এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে যোগাযোগ, বাণিজ্য বৃদ্ধিসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অবশ্য দেশের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর ভূমিকা নিয়ে বিশ্ব ব্যাংক যে অভিমত জানিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, সেতুটি বাস্তবায়িত হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে যাবে। আর প্রতিবছর দারিদ্র্য নিরসন হবে শূন্য দশমিক ৮৪ ভাগ। এর মাধ্যমে অর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় ৬ কোটি মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন আনবে পদ্মা সেতু। দেশের অর্থনীতি চাঙা করতে পদ্মা সেতু কী ধরনের ভূমিকা রাখবে সে বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, একসময় দেশের উত্তরাঞ্চলে মঙ্গা দেখা দিত। এখন কিন্তু আমরা মঙ্গার কথা আর তেমন একটা শুনি না। উত্তরাঞ্চলের এই মঙ্গা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে যমুনা সেতু বা বঙ্গবন্ধু সেতু। ঠিক একইভাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো এখনও শিল্পের দিক দিয়ে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। এ এলাকার বেশ কয়েকটি জেলার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ শেষ হলে সবার আগে উপকার হবে এই পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর। কারণ পদ্মা সেতুর কল্যাণে ওইসব এলাকায় ব্যাপক আকারে শিল্পায়ন হবে, লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। মানুষের আয় বাড়বে  জীবনে পরিবর্তন আসবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে এই সেতুকে ঘিরে উদ্যোক্তারা নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে দিয়েছেন। সামনে আরও নদী-বন্দর, সমুদ্রবন্দর চালু হতে যাচ্ছে। মোংলা বন্দরেরও প্রসার ঘটছে। ইকোনমিক জোনও হচ্ছে। সব মিলিয়ে ওই এলাকায় একটা অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিস্তার ঘটবে বলে মনে করি। পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, দুই পাড়েই জমির বেচাকেনা চলছে ব্যাপক হারে। ঢাকা থেকে বড় বড় শিল্প উদ্যোক্তারা কারখানা গড়তে জমির জন্য ঘুরছেন ওই এলাকায়। এতে অবশ্য পদ্মার দুই পাড়ের স্থানীয় বাসিন্দাদের খুব লাভ হয়েছে। কারণ তাদের জমির মূল্য বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। কৃষিজমিগুলো এখন হয়ে উঠেছে অনেক মূল্যবান। এ অবস্থা নদীর এপারে কেরানীগঞ্জ থেকে শুরু করে একেবারে মাওয়া ঘাট পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশের জমি এবং ওপারে মদারীপুরের শিবচর ও শরীয়তপুরের জাজিরা থেকে একেবারে ভাঙ্গার মোড় পেরিয়ে সামনের রাস্তার দুই পাশের জমি। তা ছাড়া এসব এলাকায় বিনিয়োগের এখনই শ্রেষ্ঠ সময় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের বৃহত্তম এই সেতু প্রকল্পে উত্তরে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া উপকূল এবং দক্ষিণে শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের জাজিরা উপকূলের বিরাট এলাকার মানুষ সার্বিক দিক দিয়ে সুবিধা ও উপকারভোগী হবেন। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুকে ঘিরে বিভিন্ন শিল্প-কলকারখানা ও অত্যাধুনিক আবাসিক এলাকা স্থাপন হচ্ছে। একই সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া ২১টি জেলা- খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা। বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী জেলার মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন আনবে পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতুসংশ্লিষ্ট এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পদ্মার চরাঞ্চলে অলিম্পিক ভিলেজ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, হাইটেক পার্ক, বিমানবন্দরসহ নানা উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পদ্মা সেতুসংলগ্ন জাজিরার নাওডোবা এলাকায় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী গড়ে তোলা হচ্ছে। এখানে আধুনিক আবাসন, শিক্ষা-চিকিৎসাসহ আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা রাখা হবে। যার জন্য জমি অধিগ্রহণসহ বেশ কিছু কাজ এগিয়েছে। ঢাকার বাইরে পদ্মা সেতুর আশপাশের এলাকায় গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রসার ঘটার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। পদ্মা সেতুসংলগ্ন মুন্সীগঞ্জের লৌহজং, মাদারীপুরের শিবচরের কাঁঠালবাড়ী, চরজানাজাত ও শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, এসব এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে মহাপরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে এসব এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে এই পদ্মা সেতুকে ঘিরে। এই প্রত্যাশা এ এলাকার খেটে খাওয়া মানুষের। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে শহরায়নে রূপ নেবে এই এলাকা। তৈরি হবে একাধিক শিল্প ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যার ফলে প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলে বৃদ্ধি পাবে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর মোংলার গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা অল্প সময়ের মধ্যে পণ্য পরিবহন করে মোংলা বন্দরের মাধ্যমে রফতানি ও আমদানি করতে উৎসাহিত হবেন। দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিমায়িত মৎস্য ও পাটশিল্প যার অধিকাংশ খুলনা থেকে রফতানির মাধ্যমে আয় হয়ে থাকে। পদ্মা সেতু হলে এই আয় আরও বাড়বে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, বেনাপোল, দর্শনা ও ভোমরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমের ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থনীতির গতি সৃষ্টি হয়েছে। নদীপথে দেশি ও বিদেশি পণ্যের অভ্যন্তরীণ রফতানিতে যশোরের শিল্পশহর নওয়াপাড়ায় অন্যতম বৃহত্তম নদীবন্দর। এটি খনন ও সংস্কার চলছে। পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ প্রকল্পের কাজ চলছে জোরেশোরে। যশোরে দুটি ইপিজেড স্থাপনের তোড়জোড় চলছে। যশোর শহরতলি আরবপুর এলাকায় ৫শ একর জমির ওপর অটোমোবাইল শিল্পাঞ্চল ও যশোর-বেনাপোল সড়কে ঝিকরগাছা উপজেলায় ৬শ একর জমির ওপর ইলেকট্রনিকস, টেক্সটাইল, ওষুধ, তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের পর যশোর হবে তৃতীয় বাণিজ্যিক নগরী। এই অঞ্চল কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ। দেশি-বিদেশি অনেক বড় কোম্পানি বিনিয়োগ করবে। এখানকার উৎপাদিত পণ্যের রফতানি বাড়বে। মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বদলে যাবে জীবনযাত্রার মান। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতা ছিল পদ্মা সেতুর ফলে সেটাও দূর হবে। রাজধানীর আশপাশের জেলা গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ থেকে শুরু করে কুমিল্লা বা চট্টগ্রামের মতো শিল্পের দিক দিয়ে উন্নত হবে এ অঞ্চলের জেলাগুলো। তবে এসব এলাকায় শিল্পের বিকাশ ঘটাতে হলে কেবল পদ্মা সেতু বানালেই হবে না, জেলাগুলোর অভ্যন্তরীণ সড়ক ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে। একই সঙ্গে অন্যান্য অবকাঠামো, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎসহ শিল্প সহায়ক অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেনাপোল থেকে যশোর, নড়াইল ও ভাটিয়াপাড়া হয়ে ঢাকা সিক্স লেনের এশিয়ান হাইওয়ে সড়ক, যশোরে শেখ হাসিনা আইটি পার্ক, বাগেরহাটের ফয়লায় বিমানবন্দর, খুলনা-মোংলা রেললাইন, যশোরে দুটি ইপিজেড, খুলনায় শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, গোটা অঞ্চলে পাইপলাইনে গ্যাস, দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলা, শিল্পশহর নওয়াপাড়া নদীবন্দর, বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল, ভোমরা ও দর্শনা স্থলবন্দরের উন্নয়ন, বেনাপোল থেকে সরাসরি ঢাকা ট্রেন যোগাযোগসহ গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কোনোটি শেষ হয়েছে, আবার কোনোটি চলছে কিংবা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। এ সবই হচ্ছে পদ্মা সেতুকে ঘিরে।মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মার পাড়ে দাঁড়িয়ে কথা হয়, স্থানীয় বাসিন্দা হাবিবুর রহমন মোল্লার সঙ্গে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে আপনাদের প্রত্যাশা কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, পদ্মা সেতুকে নিয়ে আমাদের প্রত্যাশার শেষ নেই। আমরা জানতে পেরেছি, সেতুকে ঘিরে পদ্মার দুই পাড়ে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরের আদলে শহর গড়ে তোলার কথাবার্তা হচ্ছে। নদীর দুই তীরে আসলেই আধুনিক নগর গড়ে তোলা সম্ভব। তবে সে জন্য এখনই পরিকল্পনা নিতে হবে। এই সেতু ঘিরে কী কী হতে পারে, কোথায় শিল্প-কারখানা হবে, কোথায় কৃষিজমি হবে সেসব এখনই বিবেচনা করা উচিত। এই সেতুকে ঘিরে পর্যটনে যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। অনেক আধুনিক মানের হোটেল-রিসোর্ট গড়ে উঠবে। সবচেয়ে বড় কথা এসব উন্নয়ন হলে আমাদের এলাকার বেকার যুবকদের ব্যাপকহারে কর্মসংস্থান হবে সবার আগে। এটি আমাদের কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি।’